ছয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে রাজনীতি থেকে অবসরে পাঠানোর উদ্যোগ
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক

নেপাল গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ অস্থিরতার মুখোমুখি পড়েছে গত কয়েক দিনের টানা আন্দোলনে। দেশটির ভেতরে চলমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় নতুন এক প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় সারির নেতারা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে নেপালি রাজনীতিকে প্রভাবিত করা আসা ছয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিতে হবে।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগের পর নেপালজুড়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিরুদ্ধে জেন-জি প্রজন্মের আন্দোলনের চাপেই তার এই পদত্যাগ। প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওডেল দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার সমন্বয় করছে।
বিক্ষোভকারীদের প্রধান দাবি হলো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন। এ ক্ষেত্রে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করার বিষয়ে আন্দোলনকারী ও রাজনৈতিক মহলে এক ধরনের ঐকমত্য গড়ে উঠছে। বিভিন্ন দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন-ইউএমএল, মাওবাদী কেন্দ্র ও ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্ট; চার দলের দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব চাইছেন ওলি, শেরবাহাদুর দেবুয়া, পুষ্পকমল দাহাল প্রচণ্ড, মাধবকুমার নেপাল, ঝলানাথ খানাল ও ড. বাবুরাম ভট্টরায়কে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে। এর মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্বের পথ উন্মুক্ত হবে বলে তারা মনে করছেন।
এক বামপন্থি দলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা চাই ছয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে বিবৃতি দিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিন। দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন নেতৃত্বের সুযোগ দিতে হবে। ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্টের ঝলানাথ খানাল প্রস্তাবের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। একইভাবে ড. বাবুরাম ভট্টরায়ও কিছু ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সরে দাঁড়াতে রাজি আছেন বলে দলের ভেতরে আলোচনা চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আলোচনায় প্রেসিডেন্টের বাসভবনে সেনাপ্রধান: নেপালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা করতে প্রেসিডেন্টের বাসভবন শীতল নিবাসে যান দেশটির সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল। সাবেক বিচারপতি সুশীলা কার্কির নেতৃত্বে সরকার গঠনের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করতে গতকাল শুক্রবার এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়। প্রেডিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিক্ষোভকারী বা জেন-জি’দের সঙ্গে আলোচনা করার কথা রয়েছে সেনাপ্রধানের।
বিক্ষোভে ৫১ জন নিহত: নেপালে জেন-জি বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫১ জন হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্য ও একজন ভারতীয় নারীও আছেন। নেপাল পুলিশের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র ও ডিআইজি বিনোদ ঘিমিরে এসব তথ্য জানান। হাসপাতালগুলোতে ক্রমাগত আহতদের ভিড় বাড়ছে। বিক্ষোভ কিছুটা শীতল হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনা ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সংসদ ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সেনা পাহারা বসানো হয়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় সীমান্তেও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
আতঙ্কে ভারত ছাড়ছেন নেপালের নাগরিকরা: একসময় কাজের খোঁজে ভারতে যাওয়া বহু নেপালি সীমান্ত পেরিয়ে এখন স্বদেশে ফিরছেন। কারণ নেপালে বিভিন্ন বাড়িতে আগুন, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে অভিবাসী শ্রমিক সারোজ নেভারবানি বলেন, বাড়িতে সমস্যা চলছে, তাই ফিরতেই হবে। আমার বাবা-মা ওখানে আছেন পরিস্থিতি খুব খারাপ। পেসাল ও লক্ষ্মণ ভাট নামের দুইজন বলেন, আমরা কিছুই জানি না, শুধু জানি বাড়ি ফিরে যেতে হবে। তাদের অনেকের ফেরার পেছনে শুধু রোজগার বা চাকরির প্রশ্ন নেই—এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিবার, নিরাপত্তাহীনতা, আর সেই অভিবাসনের চক্র, যা বহু প্রজন্ম ধরে নেপালিদের জীবনের অংশ।
ভারতে অবস্থানরত নেপালিরা তিন ভাগে বিভক্ত: প্রথমত, ঋতুভিত্তিক বা মৌসুমি শ্রমিক। যারা পরিবারের সদস্যদের নেপালে রেখে ভারতে কাজ করতে আসেন- রাঁধুনি, গৃহকর্মী, নিরাপত্তারক্ষী বা স্বল্প মজুরির শ্রমিক হিসেবে। তারা নেপালের নাগরিকই থাকেন, ভারতের আধার কার্ড পান না, এবং প্রায়ই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবা থেকে বঞ্চিত হন। দ্বিতীয়ত, পরিবারসহ স্থানান্তরিত। তারা ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, পরিচয়পত্র পান, জীবন গড়ে তোলেন, তবুও নেপালি নাগরিকত্ব রাখেন এবং দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। এমনকি ভোট দিতেও ফিরে যান। তৃতীয়ত, ভারতীয় নাগরিক নেপালি বংশোদ্ভূতরা। ১৮শ থেকে ২০শ শতকের অভিবাসনের ধারায় যারা ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তারা ভারতীয় হলেও সাংস্কৃতিকভাবে নেপালের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেন। ভারতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও নেপালিদের সংখ্যাই সর্বাধিক- সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ৪৭ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ হাজারের বেশি নেপালি। তাছাড়া, প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ খোলা সীমান্ত ও ১৯৫০ সালের শান্তি ও মৈত্রীর চুক্তির সুবাদে বহু নেপালি ভারতে আসেন চিকিৎসা, কেনাকাটা বা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেশব বাশ্যাল জানান, নতুন নেপালি শ্রমিকদের বেশিরভাগের বয়স ১৫-২০ বছরের মধ্যে হলেও গড় বয়স ৩৫ বছর। বেকারত্ব ও বৈষম্যই এই অভিবাসনের মূল চালিকাশক্তি, বিশেষ করে দরিদ্র, গ্রামীণ ও কম শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, যাদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ এমনিতেই কম। তিনি বলেন, তাদের বেশিরভাগ কাজ করেন নির্মাণক্ষেত্রে, উত্তরাখণ্ডের ধর্মীয় স্থানে, পাঞ্জাবের কৃষিখেতে, গুজরাটের কারখানায় এবং দিল্লি ও অন্যান্য শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁয়। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক রাজনৈতিক নৃতত্ত্ববিদ জীবন শর্মা বলেন, খোলা সীমান্তের কারণে ভারতে কতজন নেপালি নাগরিক কাজ বা বসবাস করছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে অনুমান করা হয় এই সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ লাখের কাছাকাছি।
দেশত্যাগে ভিসানীতি শিথিল করল নেপাল: কাঠমান্ডু উপত্যকায় চলমান কারফিউ ও অস্থিরতার মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সহায়তা করতে নেপালের অভিবাসন বিভাগ সাময়িকভাবে ভিসা ও প্রস্থানের প্রক্রিয়া সহজ করেছে।
অভিবাসন দপ্তরের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, যেসব বিদেশি নাগরিকের ভিসা ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈধ ছিল, তারা এখন অতিরিক্ত কোনো ফি ছাড়াই ভিসা হালনাগাদ ও প্রস্থানের অনুমতিপত্র (এক্সিট পারমিট) সংগ্রহ করতে পারবেন। এই সেবা অভিবাসন দপ্তরে অথবা সরাসরি দেশের বাইরে যাওয়ার নির্দিষ্ট পয়েন্টে পাওয়া যাবে। এছাড়াও, অস্থিরতার মধ্যে যাদের পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে তাদের জন্য ভিসা স্থানান্তরের বিশেষ ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এমার্জেন্সি পাসপোর্ট বা দূতাবাস কর্তৃক ইস্যু করা অন্য কোনো ভ্রমণ দলিল নিয়ে যারা যাত্রা করছেন, তাদের নতুন নথিতে পুরোনো ভিসা স্থানান্তর করা হবে।
যাতে তাদের দেশত্যাগ প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন হয়। এদিকে বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী নিয়ে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্যের ব্যাপারে সতর্ক করে দেশটির সেনাবাহিনী জনগণকে গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। নেপালের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বাহিনীটি নিয়মিতভাবে প্রেস বিজ্ঞপ্তি, প্রেস নোট এবং নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বার্তা ও কার্যক্রম সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করে আসছে।
