শেখ হাসিনার আরও দুই লকার জব্দ

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ঘটনায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। গতকাল বুধবার সকাল ১১টায় ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করে। অন্য দুই সদস্য হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর। এদিন শহীদ সজলের বাবা খলিলুর রহমানের জেরা অব্যাহত রাখেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ও আসামিপক্ষ। এরপর নতুন দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার। এর আগে, গত সোমবার শহীদ আস সাবুরের ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম এবং সজলের বাবা খলিলুর রহমান প্রথম দিনের সাক্ষ্য দেন। তবে সেদিন খলিলুর রহমানের জেরা শেষ হয়নি।

মামলার সূচনা বক্তব্য তুলে ধরা হয় গত ১৪ সেপ্টেম্বর। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আশুলিয়ায় গত বছরের ৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আন্দোলন দমন করতে ছয়জন তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর তাদের লাশ পুলিশের ভ্যানে তুলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এমনকি একজন তখনো জীবিত ছিলেন, তাকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয় তাকে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে ছিল চরম নিষ্ঠুরতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতিচ্ছবি। এ ঘটনায় ১১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করে প্রসিকিউশন।

চলতি বছরের ২১ আগস্ট ১৬ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিন আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাঠ করে শোনানো হয়। উপস্থিত আটজনের মধ্যে সাতজন নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তবে এসআই শেখ আবজালুল হক দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করে আদালত, এবং লিখিত আবেদন পর রাজসাক্ষী হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়।

মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আট আসামির মধ্যে রয়েছেন, মো. আব্দুল্লাহিল কাফী (সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ঢাকা জেলা), মো. শাহিদুল ইসলাম (সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সাভার সার্কেল), পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, এসআই আবজাল এবং কনস্টেবল মুকুল।

সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ অপর আট আসামি পলাতক। তাদের খুঁজে বের করে আদালতে হাজির করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি রয়েছে এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রসিকিউশনের দাখিল করা চার্জশিটে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ছয় তরুণ নিহত হন। পরে তাদের লাশ একটি ভ্যানে তুলে নির্জন স্থানে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় একজন আহতাবস্থায় বেঁচে ছিলেন, তাকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।

মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। প্রসিকিউশন তাদের অভিযোগে ৬২ জন সাক্ষীর নাম, ৩১৩ পৃষ্ঠার তথ্য এবং ১৬৮ পৃষ্ঠার প্রমাণাদি দাখিল করেছে। সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে দুটি পেনড্রাইভও।

শেখ হাসিনার অগ্রণী ব্যাংকে থাকা দুটি লকার জব্দ করেছেন কর গোয়েন্দারা : পূবালী ব্যাংকের পর এবার অগ্রণী ব্যাংকে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি লকার জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। গতকাল বুধবার গোপন খবরের ভিত্তিতে এই লকার জব্দ করা হয়। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখায় (সাবেক স্থানীয় কার্যালয় শাখা) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি লকার আছে। লকারের নম্বর দুটি হলো ৭৫১ ও ৭৫৩। কর ফাঁকি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে এই দুটি লকার জব্দ করা হয় বলে জানা গেছে। এর আগে ১০ সেপ্টেম্বর পূবালী ব্যাংকে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লকার জব্দ করেছিল এনবিআর সিআইসি। সেনা কল্যাণ ভবনে অবস্থিত পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখার ১২৮ নম্বর লকারটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে অগ্রণী ও পূবালী ব্যাংকে থাকা তিনটি লকার জব্দ করা হলো।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, পূবালী ব্যাংকের ওই শাখায় শেখ হাসিনার দুটি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। একটি হিসাবে ১২ লাখ টাকা এফডিআর আছে। আরেকটি হিসাবে ৪৪ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এসব হিসাব এখন জব্দ করা হয়েছে। টাকা উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে এনবিআরের গোয়েন্দা সেলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বৃহত্তর তদন্তের স্বার্থে শেখ হাসিনার লকার ও হিসাব জব্দ করা হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কর ফাঁকি ও দুর্নীতির তদন্তে নামে। এর অংশ হিসেবে এনবিআর শেখ হাসিনার লকার জব্দ করেছে।

শেখ হাসিনাসহ ৩৯ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় মো. জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৯ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার আদালতের পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-পরিদর্শক জাকির হোসেন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আসামিরা বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপ-পরিদর্শক নাজমুল আমিন দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। পরে ২ জুলাই ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুয়েল রানার আদালত সেটি মঞ্জুর করেন।

দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ পাওয়া উল্লেখযোগ্য আসামি হলেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আওয়াল, আওয়ামী মহিলা লীগের সদস্য নুজহাত সারওয়াত তমা, মিরপুর যুবলীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক মো. রাকিবুল ইসলাম, শেরেবাংলা নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. বশির আহমেদ প্রমুখ।

মামলার অভিযোগে সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২১ জুলাই আন্দোলন চলাকালে ভাটারা থানা এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেন জাহাঙ্গীর। এই আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনার নির্দেশে অন্য আসামিরা দাঙ্গা তৈরি করে। আওয়ামী লীগের অর্থের জোগানদাতাদের মদতে অন্য আসামিরা অস্ত্র, গোলাবারুদ, লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে তারা একাধিক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় জাহাঙ্গীর গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ওই ঘটনায় এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাটারা থানায় হত্যা মামলা হয়।

প্লট বরাদ্দের দুর্নীতি- শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে তিন মামলায় সাক্ষ্য দিলেন পাঁচজন : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে পৃথক তিন মামলায় চতুর্থ দিনে পাঁচজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। গতকাল বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে সাক্ষীরা তাদের জবানবন্দি দেন- তবে মামলার আসামিরা পলাতক থাকায় সাক্ষীদের জেরা করা করতে পারেননি। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন আদালত। সাক্ষীরা হলেন- সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার রিয়াদ মাহমুদ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওসমান গনি, ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের রেজিস্ট্রার মিঠুন চন্দ্র বালা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের রেজিস্ট্রার নাহিদ হোসেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রসিকিউটর খান মো. মঈনুল হাসান (লিপন) এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আদালত থেকে পাঁচজন সাক্ষীকে সমন পাঠানো হয়েছিলে। এরইমধ্যে এই সাক্ষীরা আদালতে এসেছেন এবং সাক্ষ্য দিয়েছেন। গত ৩১ জুলাই এসব মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। অভিযোগ গঠন শুনানির সময়ে আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পৃথক তিন মামলার মধ্যে একটিতে শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিকসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। অপর মামলায় শেখ রেহানার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও শেখ হাসিনাসহ ১৮ জনকে এবং অন্য আরেক মামলায় শেখ হাসিনা ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। গত ২০ জুলাই ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ ও ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এ তিনটি করে মোট ছয়টি মামলা বিচারের জন্য পাঠানো হয়।

মামলার অপর আসামিদের মধ্যে রয়েছে- শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদ, সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস, সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলাম, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, সাবেক সদস্য সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলাম, উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান, হাবিবুর রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন।