রাজনীতির কঠিন সময়ে দোলাচলে এনসিপি

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি ইসলামপন্থি দলগুলার দূরত্ব তৈরি হলেও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে তাদের জোট করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ জোটের চিন্তা নিয়ে দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই কঠিন সময়ে দোলাচল বিরাজ করছে দলটির ভেতরে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সম্প্রতি ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে জুলাই অভ্যুত্থানের নায়কদের ভরাডুবি হওয়ায় এনসিপির রাজনৈতিক সামর্থ্যরে বিষয় সামনে এসেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবস্থা কীভাবে ভালো হবে, কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গঠন করলে নিজেদের শক্তিমত্তা বাড়বে, সেটি নিয়ে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ করছেন দলটির নেতারা। তারা হয়তো, এমন একটি নতুন নির্বাচনি জোট গঠনের কথা ভাবছেন, যেখানে চালকের আসনে থাকবে এনসিপি।

এর আগে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের মেয়র পদ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অবস্থানকে ঘিরে কমিশনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন এনসিপির নেতারা। এছাড়াও বিভিন্ন সংস্কার প্রশ্নে এনসিপি ও বিএনপির সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বিরোধও রয়েছে।

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির দাবিতে জামায়াতে ইসলাম ও এনসিপি একই অবস্থানে। আবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (পিআর) পদ্ধতিতে জামায়াতে সঙ্গে এনসিপির দূরত্ব রয়ে গেছে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে যাচ্ছে, সেখানে বড় দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাইছে এনসিপি। আবার বিএনপি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখনই চায় না, সেখানে বিএনপির সঙ্গে এনসিপির দূরত্ব আছে। ফলে এখন বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আপাতত দূরত্ব থাকছে। এসব সমীকরণ সামনে রেখে আগামীতে কোন দলের সঙ্গে এনসিপি জোট গঠন করবে, তা এখনও স্পষ্ট করেনি।

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির সম্পর্ক নিয়ে রাজনীতিতে নানা গুঞ্জন আছে। এনসিপির নেতারা বলছেন, তাদের দলের নেতাদের অনেকেই জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে জামায়াতের সঙ্গে সরাসরি জোটে যাওয়ার প্রশ্নে এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দ্বিধা আছে। জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন, আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, আওয়ামী লীগের বিচার এবং জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের একসঙ্গে সাতটি দল ভিন্ন ভিন্নভাবে কর্মসূচি পালন করছে। যুগপৎ আন্দোলনে এনসিপি নেই।

যুগপৎ আন্দোলন প্রসঙ্গে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গত শুক্রবার বলেছেন, সাত দফা দাবিতে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে এনসিপি নেই। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, নিম্নকক্ষে নয়, উচ্চকক্ষে পিআর চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি। তাই জামায়াতে ইসলামীসহ যে কয়টি দল যুগপৎ আন্দোলন করছে, তাদের সঙ্গে আমরা নেই।

বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই মুহূর্তে জোট নয়। স্বতন্ত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এগোবে জাতীয় নাগরিক পার্টি জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণপরিষদের বিকল্প নেই। গণপরিষদ ও জাতীয় নির্বাচন আমরা যেহেতু একসঙ্গে চাচ্ছি, তাই সেই যৌথ নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য আমরা সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি। অক্টোবরের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ের আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে আবারও মাঠে নামবে এনসিপি। নাহিদ ইসলাম আরো বলেন, ‘আমরা নিবন্ধন পেতে যাচ্ছি। শাপলা প্রতীক না দেওয়ার পক্ষে কোনো যথাযথ যুক্তি নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি। আমরা আশা করছি শাপলা প্রতীক পাব।’ এ সময় এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘জোট ও গণপরিষদের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ‘তারুণ্যের রাষ্ট্রচিন্তা’র তৃতীয় সংলাপে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, বিএনপিসহ অন্য দলের অংশ থাকা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকারের সব ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার দায় নিতে হচ্ছে তার দলকে। তিনি অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীদের কাছে রাজনীতি এখন ‘বন্দি’ হয়ে গেছে। মানুষ এনসিপির কাছে নতুনত্ব প্রত্যাশা করছে এমন মন্তব্য করে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে, আমরা তার পর্যালোচনা করি। ভুল স্বীকার করতে পারি। আপনারা পরামর্শ দেবেন, আমরা সংশোধন করে বাংলাদেশপন্থি রাজনীতি করবো।

ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে জুলাই অভ্যুত্থানের নায়কদের ভরাডুবি ফলাফলে পরই গত শনিবার রাতে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি ‘ছায়া মওদুদীবাদী’ দল প্রয়োজন নেই’। যদিও তিনি ঠিক কোন দলকে উদ্দেশ্য করে এ বক্তব্য দিয়েছেন তা লেখেননি। পোস্টে তিনি আরও লিখেন, ‘এরইমধ্যে অন্তত আধা ডজন এমন ছায়া দল রয়েছে দেশে। আপনারা বাড়তি কিছু যোগ করবেন না’। জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির টানাপোড়নে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা বিরোধও স্পষ্ট হচ্ছে। দলটির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এনসিপির মধ্যে বাম বলয় ও ইসলামপন্থি অংশের মধ্যে সম্প্রতি কিছু ইস্যুতে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে একটি ইস্যু ছিল বিশ্ববিদ্যালগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন। দলের মধ্যে বাম বলয়ের অংশটি এনসিপিকে জামায়াত ঘেঁষা অবস্থান থেকে সরে আসারও পরামর্শও দিচ্ছে।

তবে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে এখন আমাদের দূরত্ব বা সখ্যতা কোনটিই নেই। শিগগিরই তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনাও নেই। আমরা আপাতত নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েই রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচিত করার চেষ্টা করবো’। আরিফুল ইসলাম আদীব আরও বলেন, ‘জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন খেলাফত মজলিসসহ কিছু দল উচ্চ ও নিম্নকক্ষ দুই কক্ষেই পিআর পদ্ধতি চায়। কিন্তু আমাদের দাবি শুধু উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে। যুগপৎ আন্দোলনে না যাওয়া এটি অন্যতম কারণ’।

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গঠিত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ২০২১ সালে গণঅধিকার পরিষদে রূপ নেয়। আর ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরাই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কিছুদিন পর গড়ে তোলেন এনসিপি। আবার এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতারই আন্দোলন-কর্মসূচিতে হাতেখড়ি হয়েছিল নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ থেকে।

সেই হিসেবে নুরুল হক নুর এনসিপির অনেক নেতার ‘রাজনৈতিক গুরু’ বলেও বলে থাকেন কেউ কেউ।

গণঅধিকার পরিষদ গত বছর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেলেও এনসিপি এখনো তা পায়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কিছুদিন ধরেই নির্বাচনি জোট গঠন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের বিভিন্ন বিষয়ে কাছাকাছি অবস্থান নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এনসিপির দফায় দফায় অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্রগতি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে সামনের দিনগুলোতে আরো বৈঠক-আলোচনা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মাসে রাজনীতিতে নতুন একীভূত দল ও জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, লক্ষ্যের জায়গা এক ছিল, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনের পর বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকায় স্বাভাবিকভাবেই দূরত্ব তৈরি হয়। এখন যেখানে যে মতাদর্শ, ব্যক্তিগত স্বার্থ, ইচ্ছা অনিচ্ছা চেয়ার বিভিন্ন কিছু নিয়ে মতভেদ তৈরি হবে। সেখানে পার্টির রাজনীতি ভিন্ন হতে পারে।