পিআর ও জুলাই সনদে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতি
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের নির্বাচনি রাজনীতি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে পিআর ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নকে ঘিরে। দীর্ঘ সংলাপের পরও রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এরইমধ্যে নির্বাচন কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারির শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, লেভেল প্লেইং ফিল্ড এবং আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের প্রশ্নে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। এতে অন্তবর্তী সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি দলের সমঝোতা জটিল হয়ে উঠছে। এরইমধ্যে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন, আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, আওয়ামী লীগের বিচার এবং জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা-এসব দাবিতে একই দিনে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি দল কর্মসূচি পালন করেছে।
পিআর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ -সালাহউদ্দিন আহমহ : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, আলোচনার টেবিলে সমস্যার নিষ্পত্তি হবে বলেই মনে করছে বিএনপি। তবে পিআর সিস্টেমে কেউ নির্বাচন চাইলে সে বিষয়ে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন বিষয়ে তারুণ্যের রাষ্ট্রচিন্তার তৃতীয় সংলাপে এমন মন্তব্য করেন তিনি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ছাত্রদের সরকার থেকে সরে আসার আহ্বান জানানোই যথেষ্ট নয়, বরং ছাত্রদের মধ্যেও সেই তাগিদটা থাকতে হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে কীভাবে সংবিধানে বাস্তবায়ন হবে এটা নিয়ে বিচারবিভাগের মতামত নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংলাপে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, সরকারে সব দলের সুপারিশ করা উপদেষ্টা থাকলেও সরকারের ব্যর্থতার দায় দেয়া হয় এনসিপিকে। গণমাধ্যমের দ্বিমুখী আচরণ বন্ধ না হলে যে অদৃশ্য ছায়া দেশকে ঘিরে ষড়যন্ত্র করছে তারা আরও শক্তিসঞ্চার করবে বলেও মন্তব্য করেন এই এনসিপি নেতা।
‘পিআর ছাড়া নির্বাচন হবে না’-এগুলো স্বৈরাচারী বক্তব্য -সাইফুল হক : ‘পিআর কার্যকর না হলে নির্বাচন হতে দেব না’ এ ধরনের কথা শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচারী কথারই প্রতিধ্বনি বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর পল্টন মোড়ে ঢাকা মহানগর কমিটির সমাবেশ ও পদযাত্রায় তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনের আগে মানুষ অন্তত বিচার ব্যবস্থায় দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে চায়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন শুধু বড় বড় কথা বলছেন, বাস্তবে কোনো অগ্রগতি নেই। জুলাই সনদ বাস্তবায়নও সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে টেবিল আলোচনায়। তিনি বলেন, দলীয় এজেন্ডা চাপিয়ে দিতে গিয়ে সংস্কার প্রক্রিয়াকে ঝুঁকির মুখে ফেলা যাবে না। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন যদি ব্যাহত হয় তবে দেশের ভঙ্গুর অবস্থা আরও খারাপ হবে। সামাজিক নৈরাজ্য রাজনৈতিক নৈরাজ্যে রূপ নেবে। তাই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে রাজপথে নামানো যাবে না।
জুলাই সনদের অধীনেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দাবি জামায়াতের : পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছে। এই হত্যার সাথে জড়িত বিচারক, আইনজীবী, সাক্ষীসহ সবাইকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, গণহত্যার বিচার এবং সংবিধানের মৌলিক সংস্কার ছাড়া যেনতেন নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছে ইউনূস সরকার। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষ আওয়ামী স্টাইলের নির্বাচন আর মেনে নেবে না। আমরা ফেব্রুয়ারি মাসেই নির্বাচন চাই, এর কোনো ব্যত্যয় গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে অবশ্যই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করে সেই সনদের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে।’ গতকাল শনিবার বগুড়া শহরের শহীদ টিটু পৌর পার্ক মিলনায়তনে শহর জামায়াতের ষান্মাসিক সদস্য (রুকন) সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মাওলানা রফিকুল ইসলাম বলেন, দেশের মানুষ বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। এখান থেকে পিছু হটার সুযোগ নেই। হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, ড. ইউনূসের চারপাশে ফ্যাসিবাদের দোসর ও ষড়যন্ত্রকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা সরকারকে বিভ্রান্ত করছে এবং একটি দলের পকেটে ঢুকানোর চক্রান্ত করছে। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান কোনো দল বা ব্যক্তির নেতৃত্বে হয়নি, বরং দেশের ১৮ কোটি মানুষ ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির জন্য রক্ত ঢেলে দিয়েছে। সরকারকে জনগণের মুখের ভাষা বুঝতে হবে, ব্যর্থ হলে পরিণতি শুভ হবে না। তিনি আরো বলেন, পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছে। এই হত্যার সাথে জড়িত বিচারক, আইনজীবী, সাক্ষীসহ সবাইকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। প্রশাসনের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদেরও গ্রেফতার করতে হবে। সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
জামায়াতের এই নেতা বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী, দুর্নীতিমুক্ত, চাঁদাবাজমুক্ত, মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চায়। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে আসার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।
শহর জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা আবিদুর রহমান সোহেলের সভাপতিত্বে সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দীন, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানী, বগুড়া অঞ্চলের টিম সদস্য অধ্যাপক মাওলানা আব্দুর রহিম ও অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
জুলাই সনদ অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি খেলাফত মজলিসের : জুলাই সনদ অবিলম্বে সরকারকে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর পুরানা পল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নির্বাহী বৈঠকে এই দাবি জানানো হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ এবং পরিচালনা করেন মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জনগণের অধিকার আদায়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ঘোষিত ৫ দফা দাবি আদায়ে চলমান কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক থেকে সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা দেওয়া হয়- সরকারকে অবিলম্বে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, জুলাই সনদ জাতির মুক্তির সনদ। এটি উপেক্ষা করা হলে জাতীয় জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।
কেন্দ্রীয় বৈঠকে জানানো হয়, সংগঠনের কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিশাল বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের সব বিভাগীয় শহরে একযোগে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হয়। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, জুলাই সনদ কেবল রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র নয়; বরং এটি হতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, ইসলামি মূল্যবোধ সংরক্ষণ এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার সুস্পষ্ট রূপরেখা।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা, থানা-মহল্লা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করা হবে। নেতৃবৃন্দ বলেন, জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস শেষ পর্যন্ত রাজপথে থাকবে।
বৈঠকে ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান সফরত আমিরে মজলিস মাওলানা মামুনুল হকের সফর নিয়েও আলোচনা হয়। নেতৃবৃন্দ সময়োপযোগী এই সফরকে স্বাগত জানিয়ে আশা প্রকাশ করেন-বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা-খাতে দুই দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং উভয় দেশই এতে উপকৃত হবে। তারা আরও আশা প্রকাশ করেন, সরকারও এ সফরের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
সভায় নেতৃবৃন্দ বলেন, আমিরে মজলিস মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বে আগামী দিনের কর্মপন্থা আরও শক্তিশালী করা হবে। একইসঙ্গে সব নেতাকর্মীকে আসন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাচণ্ডগানের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানানো হয় এবং অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে বৈঠকে শিশুদের নৈতিক ও চারিত্রিক বিকাশের স্বার্থে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জোর দাবি উত্থাপন করা হয়।
সভায় বলা হয়, ইসলাম, দেশ ও জনগণের কল্যাণে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- অভিভাবক পরিষদের সদস্য মাওলানা আলী আকরাম, নায়েবে আমীর মাওলানা আফজালুর রহমান, মাওলানা রেজাউল করীম জালালী, মুফতী সাঈদ নূর, মাওলানা মুহিউদ্দীন রব্বানী, মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন, মাওলানা আব্দুল আজীজ প্রমুখ।
