২১ দিন পেছাল রাকসুর ভোট

প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রাবি প্রতিনিধি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন ২৫ সেপ্টেম্বর হচ্ছে না। বর্তমানে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় আগামী ১৬ অক্টোবর নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার রাতে নির্বাচন কমিশনের জরুরি সভা শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু, আবাসিক হল ও সিনেট-এ ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনপূর্ব উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। এতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান পরিস্থিতি কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূলে নয় বলে সভায় জানানো হয়। কারণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলছে এবং নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়নি। এতে আরও বলা হয়, উপর্যুক্ত বিবেচনায় রাকসু নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার স্বার্থে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার এর পরিবর্তে আগামী ১৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে রাকসুর প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. সেতাউর রহমান বলেন, আমরা সার্বিক দিকবিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করছি, নতুন যে তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে, সেদিন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচন পেছানোর পক্ষে ছিল ছাত্রদল, পেছানোর বিপক্ষে ছিল শিবির : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল ছাত্র সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয় ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল। ছাত্রদলের সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে দুর্গাপূজার পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। আর ছাত্রশিবির- সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান বলছেন, তারা ২৫ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন চান। গতকাল সোমবার দুপুরে এক বিফ্রিংয়ে ছাত্রদলের ভিপিপ্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন তাদের প্যানেলের এই অবস্থান সাংবাদিকদের জানান। বেলা ৩টার দিকে রাকসুর কোষাধ্যক্ষ কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের অবস্থান জানান ছাত্রশিবিরের ভিপিপ্রার্থী মোস্তাকুর রহমান।

শেখ নূর উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছাত্রদল সব সময় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। ক্যাম্পাসে যে উৎসবমুখর পরিবেশ ও ভোটারদের আনাগোনা ছিল, সেটা অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। ভোটার নেই বললেই চলে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বাড়িতে চলে গেছেন। আমরা চাই, সর্বোচ্চ ভোটারের উপস্থিতিতে উৎসবমুখর পরিবেশে একটি নির্বাচন। আমরা নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করব, আপনারা বিষয়টি বিবেচনা করেন, শিক্ষার্থীদের পালস বোঝার চেষ্টা করেন। আমাদের চাওয়া, নির্বাচনটা ছুটির (দুর্গাপূজার ছুটি) পরে হোক।’

এদিকে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের ভিপিপ্রার্থী মোস্তাকুর রহমান বলেছেন, ‘অনেক রাকসু বানচালকারী গোষ্ঠী নির্বাচন পেছানোর অপরাজনীতি করছে। সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে কিছু বোল্ড স্টেটমেন্ট দিয়েছি। আমাদের প্রথম মতামত হচ্ছে, যথাসময়েই নির্বাচন হতে হবে। এটা কোনোভাবেই পেছানো যাবে না। দ্বিতীয় দাবি হচ্ছে, নির্বাচনের দিন বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। তৃতীয় দাবি হচ্ছে, ভোট গণনা সুষ্ঠুভাবে হতে হবে। চতুর্থ দাবি, ভোটের দিনই ফলাফল ঘোষণা করতে হবে।’ যারা জয়ী হবে না, তারা নির্বাচন পেছানোর কথা বলছে উল্লেখ করে তিনি এই অপরাজনীতি থেকে তাদের বিরত থাকার আহ্বান জানান।

নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার সময় অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে হলে দেখেছেন দাবি করে মোস্তাকুর রহমান বলেন, যে দুই-একজন চলে যাচ্ছেন, তাঁরা এই আশঙ্কায় চলে যাচ্ছেন যে নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে কি না। প্রশাসন যদি এটা নিশ্চিত করে যে নির্বাচন ২৫ তারিখেই হবে, নির্বাচনের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের নিরাশ হওয়ার দরকার নেই।

এর আগে গতকাল দুপুরে নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করে কয়েকটি প্যানেলসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

মুখোমুখি কমপ্লিট শাটডাউন-রাকসু নির্বাচন, যা বলছেন প্রার্থীরা : পোষ্য কোটা ইস্যুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষাসহ সব কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। একইসঙ্গে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স সমিতি। এতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুখোমুখি অবস্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ অচলবস্থার সৃষ্টি হয়। এতে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।

‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি চলে গেছেন। আর পোষ্য কোটা নিয়ে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’

রাকসুর ইতিহাসে প্রথম নারী ভিপি প্রার্থী তাসিন খান বলেন, ‘বর্তমানে ক্যাম্পাসে স্থিতিশীল পরিস্থিতি নেই। প্রশাসন যদি স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তাহলে ২৫ তারিখেই রাকসু হোক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করে রাকসু দিলে সেটার আমরা বৈধতা দেব না।’

প্রসঙ্গত, গত শনিবার বিকেলে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রশাসন ভবন থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাকে আটকে বিক্ষোভ করেন। পরে তিনি গাড়ি থেকে নেমে বাসভবনের দিকে গেলে শিক্ষার্থীরা তার বাসভবনে তালা দেন। পরে উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের দিকে যান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের জুবেরী ভবনে ঢুকতে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এরপর উপ-উপাচার্যসহ কর্মকর্তাদের জুবেরী ভবনে আটকে রেখে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। পরে ১৭টি হল থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে এসে ভিসির বাসভবনের সামনে আন্দোলন করতে থাকেন। তুমুল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাত ১টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন। অপরদিকে শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদের কর্মবিরতিতে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন : পোষ্য কোটা বাতিল এবং উপ-উপাচার্যকে লাঞ্ছনার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা গতকাল সোমবার থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে শাটডাউনের আওতামুক্ত রয়েছে রাকসু নির্বাচন, পানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহন সেবা। গতকাল সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রশাসন ভবনের সামনে, সিনেট ভবনের পাশে ও আমতলায় অবস্থান নেন।

গত রোববার সিন্ডিকেট সভা শেষে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ সাংবাদিকদের জানান, উপ-উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি, নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনেরও সুপারিশ করেছে সিন্ডিকেট।

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধায় ভর্তি স্থগিতের যে ঘোষণা করা হয়েছে, সেই বিষয়টি সিন্ডিকেটকে জানানো হয়েছে। সিন্ডিকেট এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধায় আজ থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। এটা আমরা শুরু করছি না। আমাদের সংশ্লিষ্ট বডিগুলোতে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে।’

জুবেরী ভবনে শিক্ষক লাঞ্ছনাকে নজিরবিহীন ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন উপ-উপাচার্য এভাবে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এজন্য সিন্ডিকেট নিন্দা জ্ঞাপন করেছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সিন্ডিকেট বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সিন্ডিকেট সভায় পোষ্য কোটা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে রাবি অফিসার্স সমিতির সভাপতি মোক্তার হোসেন বলেন, এ সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ। কারণ, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সুবিধা আছে। এটি আমাদের না দেওয়ায় আগামীকাল থেকে আমরা কমপ্লিট শাটডাউনে যাচ্ছি। তবে পরিবহন, পানি, বিদ্যুৎ আর রাকসু এর আওতামুক্ত থাকবে।