নাজেহাল ইউনূসের তিন সফরসঙ্গী
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হওয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হামলা করেছে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপ এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারাকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদেশের মাটিতে আওয়ামী লীগের এমন কর্মকাণ্ড রাজনীতির মাঠে নতুন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী এমিরেটসের ফ্লাইট নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এসময়ে মুহম্মদ ইউনূস সরকারপ্রধান হিসেবে বিশেষ নিরাপত্তায় অন্য একটি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেও তার সফরসঙ্গী বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে বের হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিক্ষোভের মধ্যে পড়েন। বিমানবন্দরের ৪ নম্বর টার্মিনালে জড়ো হওয়া আওয়ামী লীগ কর্মীরা ইউনূসকে ‘জামায়াত-শিবিরের নেতা’ আখ্যা দিয়ে নানা স্লোগান দেয়।
মির্জা ফখরুলের প্রতিক্রিয়া : গতকাল বিকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে যা ঘটেছে, তা আবারও প্রমাণ করল আওয়ামী লীগ তাদের অন্যায়ের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করে না।’ বিচারের আওতায় আনা হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আজ পর্যন্ত যা অন্যায় করেছে, সবকিছুর বিচার আইনের মাধ্যমে হবে। দল ও দেশের স্বার্থে ধৈর্য ধরুন।’
নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের শাস্তি চায় এনসিপি: আখতার হোসেনসহ অন্যদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ ডিম নিক্ষেপের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এ দাবি জানান। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের দেশ-বিদেশে হামলার টার্গেটে (নিশানা) পরিণত করেছে। গোপালগঞ্জে জুলাই পদযাত্রায় তাদের হত্যার চেষ্টা, উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর বিদেশে হামলার চেষ্টা এবং সর্বশেষ নিউইয়র্কের এয়ারপোর্টের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী তৎপরতারই ধারাবাহিকতা।
সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে অভিযোগ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনের ভেতরের একটি অংশের মদদেই এসব হামলা ঘটছে। আমরা দেখেছি, ট্রাইব্যুনালের বাইরে সাধারণ কোর্টে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোয় জামিন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জামিনে এসে আসামিরা অনেকেই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং শহিদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের হুমকি দিচ্ছে। দেশে ছোট ও বড় পর্যায়ে ঘটতে ঘটতে এখন দেশের বাইরেও একই ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোর দায়িত্ব সরকারের। সেটার জন্য সরকারের যে সর্বস্তরে ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনও রয়ে গেছে, তাদের অপসারণ করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
হাসিনার গুলির সামনে ভয় পাই নাই, ছোড়া ডিমে কিছু যায়-আসে না, বললেন আখতার হোসেন: যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বিমানবন্দরে যুবলীগ নেতার ডিম ছোড়ার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এনসিপি সদস্যসচিব আখতার হোসেন। আখতার হোসেন বলেছেন, ‘আমরা সেই প্রজন্ম, যারা হাসিনার গুলির সামনে দাঁড়াতে ভয় পাই নাই। অতএব, কারও ছোড়া ডিমে আমাদের কিছু যায়-আসে না। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। আওয়ামী লীগ জন্মগতভাবে ও প্রকৃতিগতভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা সন্ত্রাস করবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ডায়াসপোরা অ্যালায়েন্সের ফেসবুক পেজে প্রচারিত এক ভিডিওতে আখতার হোসেনকে এ কথা বলতে শোনা যায়। এ ছাড়া নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি এ সম্পর্কিত একটি পোস্ট দিয়েছেন। অ্যাকাউন্টটি আখতার হোসেনের বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আখতার হোসেন বলেন, ‘এয়ারপোর্টে আজকে আওয়ামী লীগ হুংকার দিয়ে আসছিল, অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিল, বিশেষ করে তাসনিম জারাকে (এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক) উদ্দেশ্য করে। এটাই আওয়ামী লীগের চরিত্র।’
ভিডিওতে আখতারকে বলতে শোনা যায়, ‘বাংলাদেশের যারা স্বাধীনতাকামী মানুষ, জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির মানুষ, তাদের ওপর এভাবে হামলে পড়বে, এতে আমরা অবাক হই না। বরং আমরা মনে করি, এই এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য যে প্রক্রিয়া শুরু করার কথা ছিল, সেটা সামান্য অগ্রসর হয়েছে। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী যারা পালিয়ে এসেছে, তারা বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাস করছে।’ দেশে এবং দেশের বাইরে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর, যারা সন্ত্রাস করছে, তাদের ফিরিয়ে নিয়ে বিচারের আওতায় নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান আখতার হোসেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনকে ডিম ছোড়েন যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমান।
এ ঘটনায় এনসিপি ডায়াসপোরা অ্যালায়েন্স এক বিবৃতিতে বলেছে, এ ঘটনা শুধু রাজনৈতিক সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার উদাহরণ। যদি সরকারি সফরের অংশগ্রহণকারীরা ন্যূনতম নিরাপত্তা না পান, তবে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি কনস্যুলেট ও দূতাবাসগুলোর অস্তিত্বের যৌক্তিকতা কোথায় সে প্রশ্ন তোলে এই অ্যালায়েন্স। বাংলাদেশি কনস্যুলেট ও দূতাবাস কাদের স্বার্থে কাজ করছে এবং এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তোলা হয়। এনসিপি ডায়াসপোরা অ্যালায়েন্স আরও বলেছে, আখতার হোসেন ও এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারার সঙ্গে এ হামলার সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যরাও ছিলেন। বাকিরা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তোপের মুখে পড়লেও হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে মূলত এনসিপি নেতাদের। অ্যালায়েন্স আরও বলছে, জুলাই বিপ্লবের সময় যারা জীবন বাজি রেখে লড়েছিলেন, তাদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হামলাকারীদের ক্ষোভ থামেনি। আখতার হোসেনকে এখনো তার সংগ্রামের মূল্য দিতে হচ্ছে, এটা অন্তর্বর্তী সরকারের চরম ব্যর্থতা।
গণসংহতির নিন্দা : গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এক যৌথ বিবৃতিতে আখতার হোসেনকে ডিম ছোড়ার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তার পাশাপাশি সফরসঙ্গীদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু এ হামলার ঘটনা প্রমাণ করে, তারা সফররত রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। গণসংহতির নেতারা বলেছেন, এ ধরনের হামলার ঘটনা প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগ নিপীড়কের চরিত্র বহাল রেখেছে। সরকারের বিভিন্ন অংশ, বিশেষভাবে আমলাতন্ত্রে কোনো সংস্কার ছাড়াই ফ্যাসিবাদের সহযোগীদের বহাল করা এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছে, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
মির্জা ফখরুলের ঢাল হলেন কারা : জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. তাহেরকে চারপাশ ঘিরে ঘন নিরাপত্তা দিয়ে সুরক্ষিতভাবে গাড়িতে তুলে দেন জামায়াতের কর্মীরা। ফলে তাকে কোনো ধরনের অপমান বা হামলার শিকার হতে হয়নি। অন্যদিকে, বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময়ে মির্জা ফখরুল, আখতার হোসেন ও তাসনিম জারাকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হেনস্তা করেন। এসময়ে বিমানবন্দরে বিএনপি কিংবা এনসিপির তেমন কোনো কর্মী উপস্থিত ছিলেন না।
জানা যায়, ফখরুল, আখতার ও তাসনিম জারা বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরের নেতারা তাদের চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে গাড়ির দিকে নিরাপদে এগিয়ে দেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মারুফ হোসেন নেতৃত্ব দেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন।
ফ্রান্সপ্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, বিএনপি নেতাদের সঠিকভাবে রিসিভ করার ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি বিব্রতকর হয়েছিল। তিনি মন্তব্য করেন, জামায়াত-শিবিরের সুশৃঙ্খল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এসময় ফখরুলদের প্রাণরক্ষা করেছে।
সাংবাদিক নাজমুস সাকিবও উল্লেখ করেন, দেশের ভেতরে যেমন, দেশের বাইরে জামায়াত-শিবিরের সংগঠন এখনও অটুট, যেখানে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কার্যত দায়িত্বহীন অবস্থায় ছিল। তিনি জানান, বিএনপি যদি এভাবে নেতাদের ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যতের রাজনীতি সাজায়, তা দলের জন্য ফলপ্রসূ হবে না।
বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মারুফ হোসেন। তিনি নিউইয়র্কে থাকা দলীয় কর্মীদের নেতৃত্ব দেন এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতাদের ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেন।
ডিম নিক্ষেপকারী আটক : আখতার হোসেনকে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনায় মিজানুর রহমান চৌধুরীকে আটক করেছে নিউইয়র্ক পুলিশ। আটক করা ব্যক্তি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। পরিস্থিতির জটিলতা এবং উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশের কনস্যুলেট এরইমধ্যে নিউইয়র্ক পুলিশ, মেয়র অফিস এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিস বিভাগে চিঠি দিয়ে ড. ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন। তার ভাষণে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয় তুলে ধরবেন।
