ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় জাতিসংঘে

* ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল ফ্রান্স, বেলজিয়াম, মাল্টা, অ্যান্ডোরা, লুক্সেমবার্গ ও মোনাকো * গাজাবাসীর সহায়তায় এগিয়ে আসুন, আর বসে থাকার সময় নেই : ম্যাক্রোঁ * ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে সব দেশের প্রতি আহ্বান সৌদি আরবের * নেতানিয়াহু হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে : এরদোয়ান * আগে ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করুন : স্পেন

প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের শীর্ষ সম্মেলনে ফ্রান্সসহ আরও কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্মেলনে যে ছয়টি দেশ এ স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে, সেগুলো হলো- অ্যান্ডোরা, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও মোনাকো। এর আগে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

সোমবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ‘ফিলিস্তিন প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়নের জন্য উচ্চণ্ডপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ উদ্বোধন করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘শান্তির সময় এসে গেছে; কারণ, আমরা এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি, যখন এটি আর হাতছাড়া করার সুযোগ নেই।’ ম্যাক্রোঁ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার মুখেও তিনি এ পদক্ষেপকে শান্তির স্বার্থে নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করেন। সাধারণ পরিষদে ম্যাক্রোঁ যখন বলেন, ফ্রান্স আজ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তখন ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদল উল্লাস প্রকাশ করে। তিনি বলেন, এ পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ ত্বরান্বিত করেছেন।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘যুদ্ধ, গাজায় বোমা হামলা, গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করার সময় এসেছে।’ তিনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে ফরাসি দূতাবাস খোলার সম্ভাব্য শর্ত হিসেবে গাজায় থাকা ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি এবং একটি যুদ্ধবিরতির কথা উল্লেখ করেন। ম্যাক্রোঁ আরও বলেন, ‘শান্তির পথ তৈরি করা এবং দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখার ঐতিহাসিক দায়িত্ব আজ আমাদের কাঁধে, এবং তার সময় এসে গেছে।’ এখনও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি না দেওয়া দেশগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, এখন আর অপেক্ষা করার সময় নেই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো নিশ্চিত করা ইসরায়েলের ‘পরম দায়িত্ব’।

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে সবার প্রতি আহ্বান সৌদির : সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোকে ধন্যবাদ জানান এবং সম্মেলনকে শান্তি অর্জনের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে অভিহিত করেন। বিন ফারহান সব দেশের প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর উদাহরণ অনুসরণ করার আহ্বান জানান।

জাতিসংঘের সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা অন্য সব দেশকে এমন একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি, যা দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।’ তিনি পশ্চিমতীরে ইসরায়েলের লঙ্ঘন এবং আরব ও মুসলিম দেশগুলোর ওপর বারবার হামলার তীব্র নিন্দা জানান। বিশেষ করে কাতারের দোহায় সর্বশেষ ইসরায়েলি হামলার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এই কর্মকাণ্ডগুলো ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা প্রতিফলিত করে, যা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং এ অঞ্চলের শান্তি প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।’

ফিলিস্তিনের পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব না থাকায় গুতেরেসের হতাশা : ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দলকে পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব নিয়ে অধিবেশনে যোগ দিতে বাধা দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি গাজায় অবিলম্বে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, বন্দিদের মুক্তি ও অবরুদ্ধ এলাকায় সহায়তা প্রবেশের জন্য তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি অ্যানালেনা বেয়ারবকও জোর দিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে ইসরায়েল আইনত বাধ্য।

নেতানিয়াহু হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে- এরদোয়ান : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বলেছেন, ইসরায়েল গাজায় ‘সম্পূর্ণ গণহত্যা’ চালাচ্ছে এবং এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরাসরি দায়ী। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে আমরা এটিকে অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। এটি সম্পূর্ণ একটি গণহত্যা। এবং এ গণহত্যার একমাত্র কারণ নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহু নির্দয়ভাবে, দুঃখজনকভাবে এই গণহত্যার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন।’ তিনি বলেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এখন ইসরায়েলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তুর্কি প্রেসিডেন্ট নিশ্চিত করেন, ‘ইসরায়েলের দখলের নীতি সম্প্রসারিত করার লক্ষ্য স্পষ্ট- দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের স্বপ্নকে হত্যা করা, ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার জন্য কোনো জায়গা না রাখা এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে নির্বাসিত করা।’

দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান অপরিহার্য- মিসর : সম্মেলনে মিসরের প্রধানমন্ত্রী মোস্তাফা মাদবৌলি জোর দিয়ে বলেন, দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান কেবল একটি রাজনৈতিক পছন্দ বা নৈতিক বাধ্যবাধকতা নয়, বরং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য বিষয়। তিনি ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার বিরুদ্ধে তার দেশের দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। মাদবৌলি জানান, গাজায় যুদ্ধবিরতি হওয়ার পরপরই কায়রো একটি আন্তর্জাতিক পুনর্গঠন সম্মেলনের আয়োজন করবে, যার উদ্দেশ্য হলো- তহবিল সংগ্রহ করা, যাতে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমি থেকে উৎখাত না হন।

আগে ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করুন- স্পেন : সম্মেলনে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ সতর্ক করে বলেন, যখন দুটি রাষ্ট্রের একটির জনসংখ্যা গণহত্যার শিকার হচ্ছে, তখন দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান আলোর মুখ দেখবে কীভাবে। বিশ্ব নেতাদের সামনে ভাষণ দেওয়ার সময় সানচেজ বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলেও, তার চেয়েও জরুরি হলো নিজস্ব রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি জনগণের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে; এখন যুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন কিংবা মানবিক মর্যাদা- যেকোনো কিছুর ভিত্তিতেই হোক, আমাদের এই হত্যাকাণ্ড দ্রুত বন্ধ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘যখন আমরা গাজা নিয়ে আলোচনা করছি, তখন গাজার বেসামরিক জনগণের ওপর নির্বিচারে বোমা পড়ছে।’ তিনি তার বক্তব্যে ফিলিস্তিনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হিসেবে গ্রহণের আহ্বান জানান এবং বিশ্বের দেশগুলোকে ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতা থামাতে এবং ফিলিস্তিনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।