ভারতকে চেপে ধরলেন ট্রাম্প

* পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বিরল বৈঠকে ট্রাম্প * পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চোখে ট্রাম্প একজন ‘শান্তিপ্রেমী মানুষ’

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

ধাপে ধাপে ভারতের পাশ থেকে সরে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে ভারত। ব্র্যান্ডেড ও পেটেন্টযুক্ত ওষুধ আমদানিতে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী ১ অক্টোবর থেকে এ শুল্ক কার্যকর হবে। এই সিদ্ধান্তে ভারতের ওষুধ শিল্প গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প তার নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘২০২৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে আমরা যেকোনো ব্র্যান্ডেড বা পেটেন্টযুক্ত ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে ১০০ শতাংশ ট্যারিফ (শুল্ক) আরোপ করবো, যদি না সংশ্লিষ্ট কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ওষুধ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করে।’ তিনি আরও জানান, নির্মাণাধীন বলতে বোঝানো হবে ‘জমি খনন শুরু হয়েছে’ বা ‘নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে’। এসব ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপ করা হবে না। প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, এই শুল্ক আদায় সরকারের বাজেট ঘাটতি কমাতে এবং ঘরোয়া শিল্পকে উৎসাহিত করতে সহায়ক হবে।

নতুন ঘোষিত শুল্ক কাঠামোয় ট্রাম্প আরও জানান, রান্নাঘরের ক্যাবিনেট ও বাথরুম ভ্যানিটিতে ৫০ শতাংশ শুল্ক, আসবাবপত্রে ৩০ শতাংশ এবং ভারী ট্রাকে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। যদিও ট্রাম্প এই শুল্কের জন্য কোনো আইনি ব্যাখ্যা দেননি, তিনি দাবি করেন এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অন্যান্য কারণে জরুরি। ভারতীয় ওষুধ শিল্পের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। ভারতের ফার্মাসিউটিক্যালস এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিল-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতের মোট ২৭.৯ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ রপ্তানির মধ্যে ৩১ শতাংশ বা ৮.৭ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কনীতি কার্যকর হলে ভারতের ওষুধ শিল্প মারাত্মকভাবে ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে এবং দেশটির রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

শুল্ক আরোপে ভারতে নেতিবাচক প্রভাব : যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওষুধ রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। ২০২৪ অর্থবছরে ভারতের ২৭.৯ বিলিয়ন (২,৭৯০ কোটি) ডলার মূল্যের ওষুধ রপ্তানির মধ্যে ৩১ শতাংশ বা ৮.৭ বিলিয়ন (৮৭০ কোটি ডলার বা ৭৭,১৩৮ কোটি রুপি) ডলারের ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আরও ৩.৭ বিলিয়ন (৩৭০ কোটি ডলার বা ৩২,৫০৫ কোটি রুপি) ডলারের ওষুধ রপ্তানি করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত জেনেরিক ওষুধের ৪৫ শতাংশের বেশি ও বায়োসিমিলার ওষুধের ১৫ শতাংশ ভারত সরবরাহ করে। ড. রেড্ডিজ, অরবিন্দ ফার্মা, জাইডাস লাইফসায়েন্সেস, সান ফার্মা ও গ্ল্যান্ড ফার্মার মতো প্রতিষ্ঠান তাদের মোট আয়ের ৩০-৫০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে অর্জন করে। ট্রাম্পের নতুন শুল্ক মূলত ব্র্যান্ডেড ও পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধকে নিশানা করছে, যেখানে বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য রয়েছে। কিন্তু ভারত থেকে আসা জটিল জেনেরিক ও বিশেষ ওষুধও কি এ শুল্কের আওতায় পড়বে, তা অজানাই রয়ে গেছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর যুক্তরাষ্ট্রে নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা ভারতের তৈরি সস্তা জেনেরিক ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। শুল্ক বাড়লে ওষুধের দাম বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে এবং ওষুধের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কম মুনাফায় কাজ করছে, তাই শুল্ক আরোপ হলে তারা খরচ সামলাতে পারবে না এবং শেষ পর্যন্ত তা মার্কিন ভোক্তা বা বিমা প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দেবে। ট্রাম্প ইতিমধ্যে ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ ‘দণ্ড’ আছে রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখায়।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গতকাল শুক্রবার ভোরে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও উপস্থিত ছিলেন। বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকটি হয়েছে এক আন্তরিক পরিবেশে।

বৈঠকের পর প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ ও ফিল্ড মার্শাল মুনির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপ করছেন। এ সময় ট্রাম্পকে তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি দিতে ও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সমর্থন প্রকাশের ভঙ্গিমায় দেখা যায়। গণমাধ্যমকে বৈঠকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বৈঠক শুরু হওয়ার কথা ছিল ওয়াশিংটন সময় গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে (পাকিস্তান সময় দিবাগত রাত ১টা ৩০ মিনিট)। তবে কিছু নির্বাহী আদেশে সই করার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় তাদের এ বৈঠক প্রায় আধা ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয়। বৈঠক চলে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। বৈঠক শুরুর আগে ওভাল অফিসের সোনালি আসবাবে বসে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ ও ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে। অপর প্রান্তে তখন আগের অনুষ্ঠানের কাজ শেষ করছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ সময় সেনাপ্রধানকে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা যায়। আর গণমাধ্যমের কর্মীরা তাদের সরঞ্জাম গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও কক্ষে প্রবেশ করলে তিনি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দুই পাকিস্তানি নেতাকে অভিবাদন জানান।

এটি ছিল ট্রাম্প ও শাহবাজের মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। এর আগে সর্বশেষ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে হোয়াইট হাউসে যান। বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, হোয়াইট হাউসে আসছেন একজন ‘মহান নেতা’। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে আসছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও ফিল্ড মার্শালৃদুজনই দারুণ মানুষ।’ বৈঠক দেরিতে শুরু হওয়ার বিষয়টিও সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন ট্রাম্প।

সাধারণত ওভাল অফিসে ট্রাম্প নির্বাচিত গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে ছবি তোলার সুযোগ দেন। তবে এবার সংবাদমাধ্যমকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, বৈঠকে দুই পক্ষ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ এখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন। সফরে তিনি জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন, মুসলিম দেশগুলোর এক গুরুত্বপূর্ণ বহুপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়েছেন ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন।

পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে : এর আগে নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ডনকে বলেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক ‘ক্রমে উষ্ণ হচ্ছে’। বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেখেছে এশিয়ায় চীনের প্রভাব মোকাবিলার শক্তি হিসেবে। অপর দিকে পাকিস্তানকে মনে করা হয়েছে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে।

ভারতীয়দের ভিসা জটিলতা, ভারতীয় পণ্যে ওয়াশিংটনের আরোপিত উচ্চ শুল্ক এবং গত মে মাসে পাকিস্তান-ভারত সংঘাতের পর ট্রাম্পের দাবি- তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি করিয়েছেন- এসব বিষয়েই মূলত টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল নয়।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চোখে ট্রাম্প একজন ‘শান্তিপ্রেমী মানুষ’: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ গত বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং তাকে বিশ্বজুড়ে সংঘাতের অবসানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ‘ম্যান অব পিস’ বা ‘শান্তির মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ গতকাল শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময়, শেহবাজ শরিফ গাজায় যুদ্ধের তাৎক্ষণিক অবসান ঘটাতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। গেল সপ্তাহের শুরুতে নিউইয়র্কে মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে গাজা এবং পশ্চিম তীরে শান্তি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ব্যাপক মতবিনিময়ের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর মার্কিন উদ্যোগেরও প্রশংসা করেন তিনি।

তথ্যানুসারে, ‘বিরল’ এই বৈঠকে পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সাথে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ এই বছরের শুরুতে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত শুল্ক ব্যবস্থার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারিত্বের কথা স্মরণ করে শেহবাজ শরিফ আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেন যে, ট্রাম্পের নেতৃত্বে, উভয় দেশের পারস্পরিক সুবিধার জন্য পাকিস্তান-মার্কিন অংশীদারিত্ব আরও জোরদার হবে। এই প্রসঙ্গে, মার্কিন কোম্পানিগুলোকে পাকিস্তানের কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, খনি ও খনিজ সম্পদ এবং জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানান শেহবাজ।