‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারে ৫০ লাখ প্রবাসী ভোটার
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিফুল ইসলাম

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসীকে ভোটার বানাতে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিপুল সংখ্যক প্রবাসী ভোটার পছন্দের সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে কাজ করতে পারেন বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীরা এবারই প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রবাসীদের ভোট নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন ইসির কর্মকর্তারা। এ লক্ষ্যে ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা জানায়, দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে প্রবাসী ভোটার পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দেবেন। সেই প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে প্রবাস থেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোট দিতে বলবেন। এক্ষেত্রে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বড় ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়াবে প্রবাসী ভোটার। এরমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা প্রবাসী ভোটারদের গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছেন। প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণেই প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলেছিলেন। নির্বাচন কমিশনও সেই মোতাবেক প্রস্তুতি নেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। বৈঠকে তিনটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও রাজনৈতিক দলগুলো পোস্টাল ব্যালটে আগ্রহ দেখায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইটি বেইজড পোস্টাল ব্যালটে ভোট ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে সংস্থাটি। প্রবাসীদের পাশাপাশি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এতে প্রথমবারের মতো দেশের ৭১টি কারাগারের বন্দিরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, বিভিন্ন দেশে ঠিক কত সংখ্যক প্রবাসী আছে, এর সঠিক হিসাব নেই। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১ কোটি ৪০ লাখের মতো প্রবাসী আছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ বাংলাদেশি এনআইডি আছে। সেই হিসেবে ৫০ লাখের মতো ভোটার এবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে প্রবাসী ভোটের হার ২০ থেকে ২২ শতাংশের মতো হয়।
নির্বাচন কমিশন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি-বায়রাসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, ৪০টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের আধিক্য রয়েছে। এরমধ্যে- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, মিশর, ব্রুনাই, মরিশাস, ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক ও সাইপ্রাস। এসব দেশে ১ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ জন প্রবাসী রয়েছে। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশের মতো ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে বলে ধারণা করছে ইসি। যাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রবাসী ভোটারের সাড়া পাবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অ্যাপে নিবন্ধনের সময় মিলবে ১০ দিন : নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, আগামী নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার অ্যাপ (পোস্টাল ভোট বিডি) উদ্বোধন হবে। এতে প্রবাসীরা নিবন্ধন করতে সময় পাবেন ১০ দিন। তিনি বলেন, দেশের বাইরে থেকে ভোট দেওয়ার জন্য আউট অব কান্ট্রি ভোটিং রেজিস্ট্রেশনের জন্য আমরা একটি অ্যাপ ডেভেলপ করছি। সবশেষে আমরা চেষ্টা করব আরও তিন থেকে সাত দিন সময় রাখার, যারা বাদ পড়া ভোটার আছেন, তারা সুনির্দিষ্ট সময়ে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন।
প্রবাসীরা আগে ভোট দিলেও কাউকে জানাতে পারবে না : ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীরা দেশের ভোটারদের চেয়ে অন্তত দুই সপ্তাহ আগে ভোট দেবেন। তবে সেই ভোট কাকে দিলে তা প্রকাশ করতে পারবেন না মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- দুটি। প্রথম চ্যালেঞ্জ- গোপনীয়তার চ্যালেঞ্জ এবং যেটা নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। সবসময় জায়গা থেকে যাতে করে ইন্ডিভিজুয়াল ভোটাররা যেন এই গোপনীয়তাটা রক্ষা করেন। এবং সময় মতো ভোটটা দেন। কেউ যেন ভোটে ইনফ্লুয়েন্স করতে না পারে। তার ভোটটা তিনি কাকে দিয়েছেন এটা যেন ডাইভার্স না হয় এবং এটা তার ডিক্লারেশনের মধ্যেও থাকবে। তিনিও একটা আন্ডারটেকিং দেবেন। ইন্ডিভিজুয়াল ভোটার। আমাদের এখানে সচেতনতা সৃষ্টির একটা জায়গা আছে।
নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, আমরা একটা হাইব্রিড সলিউশন ইন্ট্রোডিউস করতে যাচ্ছি। সেটা যারা আগ্রহী ভোটার আছেন, যারা ভোট দিতে চাইবেন, তারা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করবেন। তাদের কাছে আগেই ব্যালট চলে যাবে। ব্যালটটি শুধুমাত্র প্রতীক সম্মলিত ব্যালট। একটা নির্দেশনা থাকবে তার জন্য, একটা ডিক্লারেশনও থাকবে। নির্দেশনাতে লেখা থাকবে যে, তিনি কবে নাগাত এই ভোটটা দিতে পারবেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে যখন প্রতীক বরাদ্দ হবে প্রার্থীর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা নিশ্চিত হবে। এরপরে তিনি তার মোবাইল ফোনে অ্যাপের মাধ্যমে অথবা আমাদের ওয়েবসাইটে দেখতে পারবেন যে তার সংসদীয় আসনে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা কী। কয়জন দাঁড়িয়েছেন এবং তাদের প্রতীক কি?
তিনি বলেন, অ্যাপে বা অনলাইনে সেই তালিকা দেখার পরে তিনি ভোট দেবেন এবং ভোট দেওয়ার পরে তিনি খামটি আবার ফেরত পাঠাবেন। এবারের ভোটের জন্য আমরা প্রবাসীদেরকে কোনো ধরনের চার্জ এপ্লাই করছি না। যদিও বা প্রতিটি ভোটের জন্য ৭০০ টাকার মতো ব্যয় হবে। আমরা মনে করি এটি একটি যৌক্তিক ব্যয় প্রবাসীদের জন্য। আউট অব কান্ট্রি ভোটিং বিষয়ে লন্ডনের বাংলাদেশ হাই কমিশন ও প্রবাসীদের সঙ্গে অনলাইনে এই মতবিনিমিয় সভার আয়োজন করে ইসি ও লন্ডন হাই কমিশন। নির্বাচন ভবনে ইসি সচিব, এনআইডি মহাপরিচালকসহ অন্য কর্মকরাতারা এবং হাইকমিশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রবাসীরা যেভাবে ভোট দেবেন : অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রবাসীরা কীভাবে ভোট দেবেন সে পদ্ধতি জানিয়েছে ইসি। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এমন দু’টি নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে। বন্ধনের জন্য প্রবাসীকে গুগল প্লে স্টোর অথবা আইনফোনের অ্যাপ স্টোর থেকে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপটি ডাউনলোড করতে হবে। এরপর লগইন করে অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হবে। মোবাইল নম্বর প্রবেশ করালে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) আসবে, তা দিয়ে মোবাইল নম্বর নিশ্চিত করবেন। এরপর নিজের ছবি তোলে দিতে হবে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআিডি হাতে নিয়ে সেলফি তুলতে হবে। পরবর্তীতে দিতে হবে এনআইডির ছবিও। এরপর পাসপোর্ট থাকলে তার ছবি দিতে হবে। সর্বশেষে বিদেশ অবস্থানরত বর্তমান ঠিকানার তথ্য দিলেই কাজ শেষ। সিস্টেম থেকে সব তথ্য যাচাই করে সত্যতা মিললে ‘আপনি এখন নিবন্ধিত’ এমন লেখা প্রদর্শিত হবে অ্যাপে। এরপর অপেক্ষা কেবল ব্যালট পেপারের জন্য।
নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর তা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ভোটেরর তথ্য চলে যাবে। সে অনুযায়ী হবে পৃথক ভোটার তালিকা। এরপর ইসি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট ভোটারের বর্তমান ঠিকানায় মার্কা বা প্রতীক সম্বলিত ব্যালট তিনটি খামে পাঠিয়ে দেবে রিটার্নিং কর্মকর্তা। একটি খামের ভেতর আরও দু’টি খাম থাকবে। যার একটিতে থাকবে ব্যালট পেপার। আসন নম্বর ও রিটার্নিং কর্মকর্তার ঠিকানা উল্লেখ করে থাকবে আরেকটি খাম। ভোটার ব্যালট পেপার বের করে ভোট দিয়ে ?দ্বিতীয় খামটিতে ভরে নিকটস্থ পোস্ট বক্সে জমা দিলেই কাজ শেষ। ইসির নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো খাম পেলে ভোটার তার অ্যাপে প্রবেশ করবেন। এরপর নির্দেশিকা দেখে মোবাইল নম্বর নিশ্চিত করবেন। এরপর নিজের ফটো তুলবেন। পরবর্তীতে খামের ওপর থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করলেই ভোটার তার আসনের সব প্রার্থীর নাম দেখতে পাবেন। আর এটা দেখা যাবে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর। প্রার্থিতা দেখার পর ভোটার তার কাছে পাঠানো খাম খুলে ব্যালট পেপার বের করে ভোট দেবেন এবং একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করবেন। এরপর ব্যালট পেপার খামে ভরে নিকটস্থ পোস্ট অফিসে জমা দেবেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মী ও আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম বলেন, ‘প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে নতুন বাংলাদেশ গঠনে অংশ নেওয়ার। বিশেষ করে যারা গত জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে প্রতিরোধ দেখিয়েছিল এবং পরে তা আবার চালু করেছিল। সেখানে আমরা সহায়তা করতে পারি কি না এবং সত্যিকার অর্থে এই নতুন বাংলাদেশে যাতে সারা বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণমূলকভাবে যুক্ত হতে পারে, সেটার একটা প্রচেষ্টা। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস শুরু থেকেই বলেছেন প্রবাসীদের নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা জরুরি।’
