অশান্ত পাহাড়

‘ভারত ও ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে’ অস্থির পাহাড়

* ভারত-ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে খাগড়াছড়িতে অস্থিরতা : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা * খাগড়াছড়িতে গুলিতে নিহত তিনজনের পরিচয় শনাক্ত * পার্বত্য তিন জেলায় অবরোধের ঘোষণা, নতুন আট দাবি * জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছবি খাগড়াছড়ির দাবি করে অপপ্রচার : বাংলাফ্যাক্ট

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

হঠাৎ করেই শান্ত পাহাড় অশান্ত হয়ে উঠেছে। খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত তিনজন নিহত ও ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সদর উপজেলা ও পৌরসভা এলাকায় এবং গুইমারা উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় বন্ধ রয়েছে শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নিয়ে টহল দিতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরে সাত প্লাটুন বিজিবি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। গত দুই দিন ধরে সংঘাত ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পাহাড়ে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাহাড়ের পরিস্থিতি থমথমে।

ভারত- ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে খাগড়াছড়িতে অস্থিরতা: গতকাল সোমবার রাজধানীর পুরাতন রমনা থানা চত্বরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, একটি মহল খাগড়াছড়িতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, কিছু সন্ত্রাসী পাহাড়ের ওপর থেকে গুলি চালাচ্ছে। এসব অস্ত্র প্রায়ই দেশের বাইরে থেকে আসে।

খাগড়াছড়িতে গুলিতে নিহত তিনজনের পরিচয় শনাক্ত: পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে গত রোববার গুলিতে নিহত তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা সবাই খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার বাসিন্দা। নিহত ব্যক্তিরা হলেন- উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের দেবলছড়ি চেয়ারম্যান পাড়ার আথুই মারমা (২১), হাফছড়ি ইউনিয়নের সাং চেং গুলিপাড়ার আথ্রাউ মারমা (২২) ও রামসু বাজার বটতলার তৈইচিং মারমা (২০)।

কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায় ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’-এর ব্যানারে ডাকা অবরোধের মধ্যেই গত রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতায় রণক্ষেত্র পরিণত হয় খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছিল স্থানীয় একটি পক্ষ। এ সময় গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। তারা তিনজনই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন।

খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদ বলেন, গত রোববার থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত আহত ১৪ জনকে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ১৩ জন চিকিৎসাধীন, একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের লাশও হাসপাতালে রয়েছে। খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, সোমবার সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহলে রয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

পার্বত্য তিন জেলায় অবরোধের ঘোষণা, নতুন ৮ দাবি: খাগড়াছড়িতে চলমান অবরোধ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের বাকি দুই জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানকে। এবার তিন পার্বত্য জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে জুম্ম ছাত্র-জনতা ফ্রন্ট। এ ফ্রন্টের ব্যানারে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিন জেলায় অবরোধের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। তবে এটিতে স্বাক্ষর নেই কোনও ছাত্র নেতার। শুধু অবরোধের আওতা বাড়েনি, নতুন বিজ্ঞপ্তিতে বাড়ানো হয়েছে দাবির সংখ্যাও। এর আগে একটি ধর্ষণ সংক্রান্ত অভিযোগ তুলে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করলেও অবরোধ পালনকারী জুম্ম ছাত্র-জনতা ফ্রন্ট এবার সেখান থেকে সরে এসে আট দফা দাবি উপস্থাপন করেছে।

দাবিগুলো হলো : ১। আলোচনার প্রারম্ভকাল থেকে পরবর্তী সময়ে পর্যন্ত যেকোনও প্রকার হামলা, সহিংসতা বা ভীতি প্রদর্শন রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনিভাবে বাধ্য থাকবে এবং সেই নিশ্চয়তা প্রদান করবে। ২। ধর্ষণ মামলার অবশিষ্ট দুই আসামিকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। ইতিমধ্যে গ্রেফতার আসামি চয়ন শীলের বিচার ত্বরান্বিত করে দণ্ড কার্যকর করা ও তা সরকারি গেজেটে বিজ্ঞাপন করে প্রকাশ করতে হবে। ভুক্তভোগীকে পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। ৩। ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় ঘটে যাওয়া সেনা-ও-সেটলারদের দ্বারা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণের ঘটনাসহ সমস্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ সংবেদনশীল আইনি তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়ে একটি অফিসিয়াল তদন্ত প্রতিবেদন আমাদেরকে ৩০ দিনের মধ্যে প্রদান করতে হবে। ৪। নিরীহ ও নিরস্ত্র জুম্ম ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত বর্বরোচিত হামলা, দোকানপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগে সৃষ্ট ক্ষতির পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আহত সবার সুচিকিৎসার দায়ভার জেলা/রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বহন করবে। ৫। শান্তিপূর্ণ অবরোধ ক্ষুণ্ন করা, সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বিনা উসকানিতে আক্রমণ এবং জুম্ম আদিবাসীদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে সে সবের পূর্ণ ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিকার দিতে হবে। ৬। চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আটক সব জুম্ম ছাত্র-জনতাকে অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। একইসঙ্গে ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর সংঘটিত হামলাসমূহের স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৭। আলোচনার টেবিলে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ছাত্র-জনতা প্রতিনিধির এবং অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ৮। ১৪৪ ধারা বাতিল করতে হবে।

স্থবির জনজীবন : খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলায় অবরোধ সম্প্রসারিত হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সংকটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। অফিস আদালত খোলা থাকলেও উপস্থিতি নেই বললেই চলে। থমথমে পরিস্থিতি চারদিকে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টার রবিবারের দেওয়া নির্দেশনার আলোকে প্রতিটা পয়েন্টে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছবি খাগড়াছড়ির দাবি করে অপপ্রচার- বাংলাফ্যাক্ট: চট্টগ্রামে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে তোলা অস্ত্রধারী আওয়ামী কর্মীর পুরোনো ছবি খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক ঘটনার দাবি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা শনাক্ত করেছে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) এর ফ্যাক্ট চেক ও মিডিয়া রিসার্চ টিম বাংলাফ্যাক্ট। বাংলাফ্যাক্ট জানায়, গত ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দাবি করা হয়, খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর সামনে সেটেলার বাঙালিরা প্রকাশ্যে জুম্মদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। তবে যাচাই করে বাংলাফ্যাক্ট নিশ্চিত করে, ছবিটি খাগড়াছড়ির নয়। এটি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান চলাকালে চট্টগ্রামে আন্দোলনকারীদের ওপর আওয়ামী সমর্থিত অস্ত্রধারীর গুলিবর্ষণের ছবি। রিভার্স ইমেজ সার্চে ছবিটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পাওয়া যায়। ‘প্রো আওয়ামী লীগ ম্যান ফায়ার্স অ্যাট এন্টি ডিসক্রিমিনেশন প্রটেস্টরস’ শিরোনামের সেই প্রতিবেদনে প্রকাশিত ছবিটির সঙ্গে আলোচিত ছবিটির মিল রয়েছে। ছবির ক্যাপশনে উল্লেখ ছিল, এটি চট্টগ্রামের এনায়েতবাজারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়কার দৃশ্য। একই তথ্য নিশ্চিত করেছে দৈনিক দেশ রূপান্তরের ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত প্রতিবেদন।

বাংলাফ্যাক্ট বলছে, খাগড়াছড়ির ঘটনার নামে যে পুরোনো ছবি ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর। গুজব ও ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে বাংলাফ্যাক্ট নিয়মিত কাজ করছে এবং যাচাই করে জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে ওই কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শয়ন শীল নামে একজনকে আটক করে পুলিশ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।