পিআর ইস্যুতে অনড় বিএনপি-জামায়াত
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক আলম

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারির রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে ভোট চায় জামায়াতে ইসলামী, অন্যদিকে বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচনে অনড় অবস্থানে বিএনপি। দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকায় এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি ঐকমত্য কমিশনে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পিআর পদ্ধতির ভালো ও মন্দ উভয় দিক উল্লেখ করা হলেও এ নিয়ে কোনো সুপারিশ করেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে বড় দুই রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে এগোনো মোটেও শুভকর নয়। দুই দলের আপত্তির জায়গায় কীভাবে সমাধান করা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। কারণ, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি, সেই আক্ষেপ রয়ে গেছে। এবারের নির্বাচনেও যদি জনগণ ঠিকভাবে ভোট প্রয়োগের সুযোগ না পান, তাহলে পুরো দায়ভার অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তাবে। সুতরাং সমঝোতার ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে দল দুটির টানাপড়নে ফ্যাসিস্টগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলে নানামুখী চক্রান্তের সুযোগ পাবে।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অংশ নেওয়া আহসান হাবিব নাহিদ ও তৌহিদ হোসেন বলেন, পিআর পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। জুলাই চেতনা ছিল ফ্যাসিবাদী সরকারকে হটিয়ে দেশের রাজনীতিতে সহযোগিতা ও সংলাপের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি তার ঠিক উল্টো দিকে যাচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলতে পারে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, পিআর পদ্ধতি শুধু একটি নির্বাচনি পদ্ধতির বিষয় নয়, এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্যও বড় পরীক্ষা। একটি পক্ষের ধারণা, এটি যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ সব দলের জন্য সমান হবে। ছোট দলগুলোও ভোট প্রাপ্তির মাধ্যমে সরকারে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। তবে রাজনৈতিক অসহযোগিতা থাকলে পদ্ধতিটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। ভোটাররা চান নির্বাচন স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য হোক। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্বে সেই চাওয়া ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকলে জনগণ হতাশ হবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা কমে যাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে, সব দল মিলে একটি সমঝোতার পথ খুঁজে বের করে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বদলে সংলাপ ও সমঝোতা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সাহায্য করবে। এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে এবং দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। নির্বাচনের সাফল্যনির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা, জনগণের আস্থা ও সহযোগিতার ওপর। সব দলকে নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। না হলে নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে নয়, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হিসেবেও চিহ্নিত হবে। পিআর পদ্ধতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করাসহ কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াত দুই দলেরই কোনও সংশয় নেই।
পিআর পদ্ধতি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না; জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই দাবিসহ আরও কিছু দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছে। সামনের দিনগুলোয় রাজনৈতিক মাঠ উত্তাল থাকবে।
পিআর পদ্ধতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের যথাযথ প্রতিফলন থাকে, যেখানে ভোটারের প্রতিটি ভোট প্রার্থী বা দল হেরে গেলেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত আসনভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি)’ ব্যবস্থায় ৩০০টি নির্বাচনি আসনে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি আসন থেকে একজন প্রার্থী সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। এ কারণেই ছোট দলগুলোর জন্য পিআর পদ্ধতি একটি কার্যকর ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কার্যকর একটি পদ্ধতি।
জাতিসংঘ সফরে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট জানান, বিএনপি পিআর পদ্ধতি চায় না। দেশের মানুষও পিআর বোঝে না। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে তো আমাদের বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট। আমরা পিআর পদ্ধতিতে যাব না। আর এ দেশের মানুষ এটা মেনে নেবে না, এবং এটা তারা বোঝেও না।’ মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আগেই বলেছি আপনারা জানেন যে, আমরা কোনো পারটিকুলার পলিটিক্যাল পার্টিকে ব্যান করার পক্ষে নই।’
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সফররত জামায়াতে ইসলামী নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুমণ্ডনির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার এবং পতিত স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা সহ সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চান তারা।
তাহের বলেন, ঐকমত্য কমিশনে ৩১ দলের মধ্যে ২৫ দলই পিআরের পক্ষে। এর মধ্যে অনেকে উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে, অনেকে নিম্নকক্ষে পিআরের পক্ষে।
গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো স্থায়ী সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় না। কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠন করা সম্ভব হয় না। একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট থাকে। এটা একটি পার্মানেন্ট রেস্টলেসনেস, যার মধ্য দিয়ে সব সময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকে। এটা বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে।
দেশের মানুষ পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে বলে দাবি করে সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, একটা জরিপে ৫৬ শতাংশ মানুষের পিআরপদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা নেই বলে জেনেছেন। আরেক জরিপে দেখেছেন, কোনো একটা দল বলছে, ৭০ শতাংশ লোক পিআর চায়। এই দুই জরিপের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যদি ৫৬ পার্সেন্ট মানুষ পিআর পদ্ধতি না-ই বোঝে, তাহলে ৭০ পার্সেন্ট মানুষ কীভাবে পিআর পদ্ধতি চায়, সেটি আমাদের বুঝে আসে না।’ পিআর পদ্ধতি প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা পিআর মানে মনে করি, পাবলিক রিলেশনস। আমরা পিআর মানে মনে করি, জনসংযোগ। এখন সবাই জনসংযোগে আছে। সেই পিআরে আমরা বিশ্বাস করি। যারা প্রোপোশনাল রিপ্রেজেন্টেটিভ মানে, পার্মানেন্ট রেস্টলেসনেস প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা সফল হবে না।’
মগবাজারের আল-ফালাহ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন এবং পিআর চালুসহ পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১ থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে গণসংযোগ, ১০ অক্টোবর ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে গণমিছিল এবং ১২ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেবে।
তিনি বলেন, আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে চাই, আমাদের ৫ দফা গণদাবি ইতোমধ্যে জনগণের কাছে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। দেশের জনগণ এই দাবির প্রতি ব্যাপক সমর্থন দিয়ে রাজপথের আন্দোলনের শামিল হয়েছে। বর্তমান সরকারের উচিত অবিলম্বে জনগণের ৫ দফা দাবি মেনে নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। সরকার যদি জনগণের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষা করে এবং বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করে তাহলে জনগণ তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কঠোর হতে বাধ্য হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার বিষয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছে। জাতির ক্রান্তিলগ্নে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ হিসেবে অতীতের বিভিন্ন নজির ও উদাহরণ তুলে ধরে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তির বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান বারবার ব্যক্ত করে আসছে। এ লক্ষ্যে জুলাই জাতীয় সনদের আইনগত ভিত্তি দেওয়ার জন্য আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে জামায়াত ইতিমধ্যে সরকারের কাছে দুটি প্রস্তাব করেছে।
প্রথমত, জুলাই জাতীয় সনদের জন্য ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করা। দ্বিতীয়ত, এই সনদের অধিকতর আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে গণভোট করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, সেটা না হলে জুলাই সনদের আইনগতভিত্তি ছাড়া ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অভ্যুত্থান ও তার অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
