শাটডাউন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মী ছাঁটাইয়ের শঙ্কা

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউন ঘিরে ব্যাপক কর্মী ছাঁটাইয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্থায়ীভাবে কর্মী ছাঁটাইয়ের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন বলেও আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। আর সেটি যদি সত্যিই কার্যকর হয়, তবে মার্কিন অর্থনীতিতে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে ১ অক্টোবর থেকে নতুন অর্থবছর শুরু হয়। অর্থবছর শুরুর প্রথম দিনেই বিগত ছয় বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সরকার কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। জাতীয় কংগ্রেস অস্থায়ী অর্থায়ন বিল পাসে ব্যর্থ হওয়ায় ফেডারেল সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে তহবিলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে এবং জাতীয় উদ্যান, পাসপোর্ট প্রসেসিংসহ বহু অত্যাবশ্যক জনসেবা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বিমানবন্দরে বিলম্ব এবং সাধারণ নাগরিকদের জন্য সেবায় ভোগান্তি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের স্থবিরতা কতদিন স্থায়ী হবে তার ওপরই এর প্রভাব নির্ভর করছে। মর্গ্যান স্ট্যানলি রিসার্চ জানিয়েছে, শাটডাউনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সপ্তাহে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ০.১ শতাংশ কমতে পারে। যদিও সমঝোতায় পৌঁছানোর পর কর্মীরা কাজে ফিরলে এ ক্ষতি আংশিকভাবে পুষিয়ে যাবে। শাটডাউনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ওপর। অক্টোবরের শেষ ভাগে ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার নিয়ে সিদ্ধান্তের আগে বিনিয়োগকারীরা শ্রমবাজার ও মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসসহ বিভিন্ন সংস্থা তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ সাময়িকভাবে স্থগিত করছে। এর ফলে বাজারে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে।

বাজেট ইস্যুতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতারা সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টা ১ মিনিট) ফেডারেল সরকারের ব্যয় চালিয়ে নিতে রিপাবলিকানদের প্রস্তাবিত তহবিল প্যাকেজ ডেমোক্র্যাটরা আটকে দেওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সময়সীমার শেষ মুহূর্তে এসে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা একে অপরের প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন বিল প্রত্যাখ্যান করে। এতে ছয় বছরের মধ্যে প্রথম শাটডাউনে চলে গেছে সরকার।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজেট অচলাবস্থার কারণে সরকারি কার্যক্রমের অর্থায়ন অক্টোবরের পর বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নানা ধরনের ভোগান্তি ডেকে আনবে। প্রভাব পড়বে বিমান ভ্রমণ থেকে শুরু করে চিড়িয়াখানা ভ্রমণ পর্যন্ত। রাজনৈতিক এই অচলাবস্থার কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ ফেডারেল কর্মী (প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার) অবৈতনিক ছুটিতে যেতে পারেন। শাটডাউনে ভ্রমণকারীরা দীর্ঘ নিরাপত্তা লাইনে পড়তে পারেন। আবার আকাশপথ নিয়ন্ত্রণকর্মী ও পরিবহন নিরাপত্তা সংস্থার (টিএসএ) কর্মীরা বেতন না পাওয়ায় কাজে অনুপস্থিত হলে ফ্লাইট বিলম্বিত হতে পারে। তবে এ ধরনের কর্মীদের ‘অপরিহার্য’ ধরা হয়, তাই তাঁরা কাজে আসবেন, কিন্তু শাটডাউন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেতন পাবেন না। ২০১৮-১৯ সালের শাটডাউনে এমন পরিস্থিতিতে কর্মীদের অনুপস্থিতি দেশজুড়ে ফ্লাইট বিলম্ব ঘটিয়েছিল। বিদেশ ভ্রমণকারীরাও সমস্যায় পড়তে পারেন। পাসপোর্ট ইস্যুতে দেরি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট সংস্থা। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়বেন ফেডারেল কর্মীরা। শাটডাউন চলাকালে তারা কোনো বেতন পাবেন না। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থার সদস্যরা কাজ চালিয়ে যাবেন, তবে তাদেরও বেতন মিলবে না। সিবিএস নিউজের তথ্য অনুযায়ী, সর্বাধিক কর্মী ছাঁটাইয়ের শিকার হবে প্রতিরক্ষা দপ্তর, স্বাস্থ্য দপ্তর, বাণিজ্য দপ্তর, পররাষ্ট্র দপ্তর ও নাসা। অগণিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান যেমন সিডিসি ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে (এনআইএইচ) চলমান গবেষণাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

কর্মীরা জীবিকার তাগিদে দ্বিতীয় চাকরি নিতে বাধ্য হতে পারেন। তবে অতীতে যেমন হয়েছে, শাটডাউন শেষে তাঁরা বকেয়া বেতন পেয়েছেন। কিন্তু ঠিকাদার কর্মীরা (যারা সরাসরি সরকারি কর্মী নন) সাধারণত বকেয়া পান না। তবে কংগ্রেসের সদস্যরা এর বাইরে থাকবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী তাঁরা বেতন পেতেই থাকবেন। শাটডাউনে ফেডারেল জমি ও জাতীয় উদ্যান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আগে শাটডাউন চলাকালে পার্ক খোলা রাখায় ব্যাপক ভাঙচুর, চুরি ও পরিবেশের ক্ষতির মতো ঘটনা ঘটেছিল। এ জন্য এবার সেগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার দাবি তুলেছেন পার্ককর্মী ও সংরক্ষণকর্মীরা।

স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের জাদুঘরগুলো অন্তত ৬ অক্টোবর পর্যন্ত খোলা থাকবে। জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো যথারীতি যত্ন পাবে, তবে জনপ্রিয় লাইভ ওয়েবক্যামসেবা বন্ধ থাকবে। ফলে দর্শনার্থীরা অনলাইনে পান্ডা, হাতি বা সিংহ দেখতে পারবেন না। বয়স্ক ও দরিদ্রদের জন্য মেডিকেয়ার ও মেডিকেইড কার্যক্রম চালু থাকবে। তবে কর্মী সংকটে পরিষেবায় বিলম্ব হতে পারে। নারী ও শিশুদের জন্য খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি (ডব্লিউআইসি) অর্থসংকটে পড়তে পারে। শাটডাউনে মার্কিন সরকার, কারণ কী এবং এর ফলে কী হয়শাটডাউনে মার্কিন সরকার, কারণ কী এবং এর ফলে কী হয় অন্য দিকে খাদ্য কুপন কর্মসূচি কিছুদিন চালু থাকলেও দীর্ঘ শাটডাউন হলে তহবিল ফুরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বন্যাবিমা কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেলে অনেক বাড়ির বন্ধক প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। আর দীর্ঘস্থায়ী হলে ফেমার (ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি) দুর্যোগ ত্রাণ তহবিলও শূন্য হয়ে যেতে পারে।

মালয়েশিয়ানদের মুক্তি না দিলে ট্রাম্পকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা: গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা (জিএসএফ) অভিযানে আটক মালয়েশিয়ান কর্মীদের মুক্তি না দিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেশটিতে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা উমনো ইয়ুথ।

সংগঠনের প্রধান ড. আকমল সালেহ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, সরকার যদি এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে ট্রাম্পের কুয়ালালামপুর সফরের সময় দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হবে।

ড. আকমল তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, যদি আমাদের কর্মীদের মুক্তি না দেওয়া হয়, তবে আমরা সরকারকে ট্রাম্পের আমন্ত্রণ বাতিল করার দাবি জানাই। অন্যথায়, মালয়েশিয়ায় তার সফরের প্রতিটি পদক্ষেপই উমনো ইয়ুথের প্রতিবাদে মুখোমুখি হবে। মালয়েশিয়ানদের ওপর হামলা মানে গোটা জাতিকে আঘাত করা। প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম এরই মধ্যে নিশ্চিত করেছেন যে ইসরায়েলি হেফাজতে ১২ জন মালয়েশিয়ান আটক রয়েছেন।

তিনি বলেন, স্বেচ্ছাসেবকদের মুক্তি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ রাখা হয়েছে এবং এ বিষয়ে নিয়মিত আপডেট দেওয়া হবে। আনোয়ার ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বলেন, সরকার তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে তিনি জনগণকে স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য প্রার্থনায় শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা হলো একটি আন্তর্জাতিক মানবিক মিশন, যার উদ্দেশ্য অবরুদ্ধ গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবকরা এই অভিযানে অংশ নেন। কিন্তু এবারও মতো এবারও ফ্লোটিলা ইসরায়েলি বাহিনীর বাধার মুখে পড়ে। ইতিহাস বলছে, ২০১০ সালে ?‘মাভি মারমারা’ নামের ফ্লোটিলা অভিযানে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হামলায় ৯ জন কর্মী নিহত হন, যা বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। তখন থেকে গাজামুখী প্রতিটি ফ্লোটিলা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত ও বিতর্কিত। মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই এসব মানবিক মিশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছে। মালয়েশিয়ানদের আটক প্রসঙ্গে এখনো পশ্চিমা শক্তিগুলোর সরাসরি অবস্থান পরিষ্কার নয়। তবে তুরস্ক, কাতারসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এরই মধ্যে নিন্দা জানিয়েছে এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে ইসরায়েলি বাধা অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছে।জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা (ওএইচসিএইচআর) এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, গাজার মানবিক পরিস্থিতি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে সহায়তা পৌঁছানো আটকানো উচিত নয়।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলতি মাসে কুয়ালালামপুরে ৪৭তম আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসার কথা রয়েছে। সফরের মূল আলোচ্যসূচি হবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও কূটনৈতিক সহযোগিতা। তবে ফ্লোটিলা ইস্যুতে মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরে যে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে, তা ট্রাম্পের সফরের কূটনৈতিক পরিবেশকে জটিল করে তুলতে পারে।