খাগড়াছড়িতে সহিংসতায় পুলিশের তিন মামলা

আসামি ১১০০

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনায় চার দিন পর তিন মামলা করেছে পুলিশ। গত বুধবার রাতে গুইমারা থানায় এ মামলা হয়। তিনটি মামলাতেই পুলিশ বাদী হয়েছে। পুলিশ জানায়, তিনটি মামলার মধ্যে একটি করা হয়েছে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, সরকারি কর্মচারীদের আহত করা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে। এতে অজ্ঞাত নামা ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আরেকটি হয়েছে হত্যার অভিযোগে। এতেও অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কেউ মামলা করতে রাজি হয়নি। অন্যটি খাগড়াছড়ি সদরে ১৪৪ ধারা ভেঙে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও সহিংসতার অভিযোগেও একটি মামলা হয়েছে। এতে অজ্ঞাত ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. এনামুল হক চৌধুরী মামলার তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, জেলাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন আছে। গোয়েন্দা নজরদারিও অব্যাহত রয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুর্গাপূজার শেষ দিনে খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন পূজামণ্ডপ পরিদর্শনকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিওন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেছেন, খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় স্থানীয়রা এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আমরা স্থানীয় জনগণের একটি বিজয় দেখতে পাচ্ছি। খাগড়াছড়ি শহর ও জেলার সাধারণ মানুষ মিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টা প্রতিহত করেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা চলাকালে সম্ভাব্য সমস্যা সবাই মিলে প্রতিহত করেছে। শেষ তিন-চার দিন যেভাবে জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে পূজা উদযাপন করেছে, তা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার জন্যও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

রিজিওন কমান্ডার আরও বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) দুর্গাপূজা শেষ হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে সকলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাবেন- এমন প্রত্যাশা করছি। জনজীবন স্বাভাবিক থাকবে এবং আমরা এগিয়ে যাবো। এসময় তিনি পূজা উদ্যোক্তা ও মণ্ডপ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং পূজা উপলক্ষে উপহার বিতরণ করেন।

১৪৪ ধারা বহাল : এদিকে খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারা উপজেলায় ১৪৪ ধারা বহাল আছে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়িতে যানবাহন এবং লোকজনের চলাচল স্বাভাবিক ছিল। জেলা থেকে দূরপাল্লার যান ছেড়ে গেছে। গতকাল খাগড়াছড়ি জেলার সাপ্তাহিক হাটের দিন হওয়ায় বাজারেও লোকজনের ভিড় দেখা গেছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হয়েছে। এরপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি মনে করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক, তাহলে ১৪৪ ধারা তুলে দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। রাতেই তাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন কিশোরী হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়। এ ঘটনায় শয়ন শীল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর এর প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে গত শনিবার খাগড়াছড়িতে অবরোধ ডাকা হয়। পরদিন থেকে তিন পার্বত্য জেলায় অবরোধের ডাক দেয় সংগঠনটি। অবরোধের মধ্যেই রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতায় রণক্ষেত্র পরিণত হয় খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজার। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখানে স্থানীয় একটি পক্ষও সংঘর্ষে যোগ দেয়। এ সময় তিনজনের মৃত্যু হয় এবং সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন। রামেসু বাজার এলাকায় আগুন দেওয়া হয় প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি ও ৪০টির মতো দোকানে।

খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা ওই কিশোরীর শারীরিক পরীক্ষার পর প্রতিবেদন জেলা সিভিল সার্জনের কাছে জমা দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। সেখানে ওই কিশোরীকে ধর্ষণের আলামত মেলেনি বলে জানানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত চায় এইচআরএফবি : খাগড়াছড়িতে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি: খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)।

২০টি মানবাধিকার সংগঠনের এ মোর্চা বলছে, এ ধরনের ঘটনা শুধু গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়; বরং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জীবন, নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক অধিকার হুমকির মুখে ফেলছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার কাছে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লেখা এক স্মারকলিপিতে এ দাবি জানায় এইচআরএফবির ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সংকট সমাধানে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ও সব অংশীজনের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করার অনুরোধ জানান তারা।

এইচআরএফবি বলছে, তারা মনে করে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বারবার সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। অথচ নিরপেক্ষ তদন্তের অভাবে অপরাধীরা শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এটি টেকসই শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।

স্মারকলিপিতে সরকারের কাছে আটটি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা; অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা, নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর পুনর্র্নিমাণে সহায়তা করা, গত এক বছরে সংঘটিত আরও সাতটি ধর্ষণের ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ থাকলে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের ভয় ও আতঙ্ক দূরীকরণে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মৌলিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার পথনকশা তৈরি করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকারের সুরক্ষা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। অতীতে সহিংসতা রোধে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে নীতি প্রণয়ন করার দাবি জানানো হয়েছে স্মারকলিপিতে।

প্রতিনিধিদলে ছিলেন এইচআরএফবির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, এইচআরএফবির সদস্য ও নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির, এইচআরএফবির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সারা হোসেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও এইচআরএফবির সদস্য ইফতেখারুজ্জামান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী ও এইচআরএফবির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য জাকির হোসেন এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপদেষ্টা মাবরুক মোহাম্মদ। স্মারকলিপিতে প্রতিনিধিদলে থাকা ছয়জনসহ স্বাক্ষর করেন এইচআরএফবির বিশেষজ্ঞ হামিদা হোসেন, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, রাজা দেবাশীষ রায়, এইচআরএফবির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক জেড আই খান পান্না, এইচআরএফবির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য রঞ্জন কর্মকার, সঞ্জীব দ্রং, সালেহ আহমদ, এইচআরএফবির সদস্য ফওজিয়া মোসলেম, শামসুল হুদা, সরদার জাহাঙ্গীর হোসেন, শিপন কুমার রবিদাস, সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, দেওয়ান জামান, পল্লব চাকমা, রোকেয়া রফিক, গীতা দাস, আবদুস সাত্তার ও আশরাফুন্নাহার।