‘রাশেদ আপনার হাত খালি আছে, লাশগুলো ঢেকে দেন’

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

হঠাৎ গুলির শব্দে ভেঙে গেল বিকেলের নিস্তব্ধতা। মুহূর্তেই আতঙ্কে ভারী হয়ে উঠল থানা ভবনের বাতাস। জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখি মানুষজনের চিৎকার আর ছোটাছুটি। অনিরাপদ ভেবে নিজেও নিচে নেমে আসি। ঠিক তখনই একটি ভ্যানে দেখি লাশের স্তূপ। এমন সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কণ্ঠ ভেসে এলো— ‘রাশেদ আপনার হাত খালি আছে, লাশগুলো ঢেকে দেন।’হৃদয়বিদারক এমনই ঘটনা উঠে এসেছে কনস্টেবল রাশেদুল ইসলামের মুখে।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১২তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি। এ মামলায় স্থানীয় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজনই রয়েছেন পলাতক।

এদিন বেলা ১১টা ১০ মিনিটে আদালতকক্ষে আসেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে বিচারিক প্যানেল। এরপর সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন কনস্টেবল রাশেদুল। প্রথমেই দেন নিজের পরিচয়। জবানবন্দিতে রাশেদুল বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানায় চালক (কনস্টেবল) হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ওই দিন আমার কোনো ডিউটি ছিল না। থানা ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থান করছিলাম। বিকেল চারটা কি সাড়ে চারটায় হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পাই। ওই সময় থানা ভবনের জানালা দিয়ে দেখি নিচে লোকজনের হইচই। সেখানে থাকা নিরাপদ না মনে করে নিচে নেমে আসি।

তিনি বলেন, নিচে নামার পর থানার মূল ফটকের বাঁ দিকে রাস্তার ওপর একটি ভ্যানে লাশের স্তুপ দেখতে পাই। আশুলিয়া থানার সাবেক ওসি সায়েদ স্যার বলেন রাশেদ আপনার হাত খালি আছে, লাশগুলো ঢেকে দেন। তখন পাশে থাকা নীল রঙের ব্যানার দিয়ে লাশগুলো আমি ঢেকে দেই। ওই সময় ওসি সায়েদ স্যারের সঙ্গে ওসি (তদন্ত) মাসুদুর রহমান, ওসি (অপারেশন) নির্মল কুমার দাস, এএসআই বিশ্বজিৎ, কনস্টেবল মুকুল চোকদার, ডিবি ইন্সপেক্টর আরাফাত ছিলেন।

এই সাক্ষী আরও বলেন, লাশগুলো ঢাকার পর থানার পশ্চিম পাশে আটতলা একটি ভবনের নিচে এক ঘণ্টা ধরে অবস্থান নেই। ওই ভবনের নিচতলার একটি ছেলেকে (যার বাড়ি জামালপুর) একটি পাঞ্জাবি ও টুপি দিতে আমি অনুরোধ করি। পরে পাঞ্জাবি ও টুপি পরে কাইচা বাড়ি রোড হয়ে জামগড়া রূপায়নে বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠি। এরপর শুনতে পাই আশুলিয়া থানার ভ্যানভর্তি লাশগুলো পুলিশের গাড়িতে তুলে পুড়িয়ে দিয়েছে। যারা এ কাজ করেছে তারা অমানবিক কাজ করেছে। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন পলাতক আট আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ও গ্রেপ্তার আসামিদের আইনজীবীরা। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ ও সাইমুম রেজা তালুকদার। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর তারেক আবদুল্লাহ, সুলতান মাহমুদসহ অন্যরা। এ নিয়ে এ মামলায় মোট ১২ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বুধবার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-২। এ মামলায় গ্রেপ্তার আটজনকে আজও ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছে পুলিশ। তারা হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, আবজাল ও কনস্টেবল মুকুল। তবে সাবেক এমপি সাইফুলসহ আটজন এখনও পলাতক রয়েছেন।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারে তদন্ত শুরু, কর্মকর্তা নিয়োগ : রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, তদন্তে অন্য দলের নাম এলে তাদের বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে গত ৫ অক্টোবর চিফ প্রসিকিউটর জানান, চলতি সপ্তাহের মধ্যে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হবে। তারই ধারাবাহিকতায় তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ২ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগ জমা দেন এনডিএমণ্ডএর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। অভিযোগে বলা হয়, আওয়ামী লীগসহ ১৪টি রাজনৈতিক দল গণহত্যার সরাসরি হুকুমদাতা হিসেবে দায়ী।

এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করছি। এটি পুরোদমে শুরু হলে বিষয়টি কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে, তা আমরা তখন জানাতে পারবো।

ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত হলে এমপি হওয়া যাবে না; প্রজ্ঞাপন জারি : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)-তে কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে তিনি আর সংসদ সদস্য (এমপি) পদে থাকতে পারবেন না কিংবা নতুন করে নির্বাচিতও হতে পারবেন না। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব হাফিজ আহমেদ চৌধুরীর সই করা প্রজ্ঞাপনে গত সোমবার এ বিধানের তথ্য জানানো হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আইসিটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কোনো চাকরি বা সরকারি পদে নিয়োগের জন্যও অযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হবে।

প্রজ্ঞাপনে আরও স্পষ্ট করা হয়েছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি কেবল সংসদ সদস্য পদের জন্যই নন, বরং স্থানীয় সরকার সংস্থার সদস্য, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসেবেও নির্বাচিত বা নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা হারাবেন।

তবে প্রজ্ঞাপনে একটি ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। যদি কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি ট্রাইব্যুনাল থেকে অব্যাহতি পান বা খালাসপ্রাপ্ত হন, তাহলে তার ক্ষেত্রে এই অযোগ্যতার বিধান প্রযোজ্য হবে না।