কোন দিকে যাচ্ছে এনসিপি

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি প্রস্তুতি ও অবস্থান স্পষ্ট হতে শুরু করলেও মাঠে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আগামী নির্বাচনে এনসিপি এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, নাকি কোনো বৃহত্তর জোটে যোগ দেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ অনিশ্চয়তাকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা চলছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট প্রায় একই রকম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি ধরে তরুণদের নিয়ে গঠিত হয় দল দুটি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতৃত্বদের নিয়ে গঠিত এনসিপি এরইমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দলটির আত্মপ্রকাশের পর প্রতীক বরাদ্দের জটিলতার মধ্যেই গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে একীভূতের গুঞ্জন উঠেছে। তবে, পরস্পরের মধ্যে আস্থার ঘাটতি এবং নেতৃত্বের হিসাব- নিকাশই একীভূত প্রক্রিয়ার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দলগুলোর ঐক্য ও জোট সম্পর্কে স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যাবে।

জানা গেছে, গণঅধিকার পরিষদ প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে। অন্যদিকে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ হওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনও নিবন্ধন ও নির্বাচনি প্রতীকের অপেক্ষায় রয়েছে। একসময়ের আন্দোলনের সহযোগী এই দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলোচনা হলেও, একই ছাতার নিচে একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা এখন কার্যত ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। একীভূত না হলেও নির্বাচনি জোট বা সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়েও দল দুটির মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ যেখানে সম্ভাব্য জোটের দরজা খোলা রেখেছে, সেখানে এনসিপি নিজেদের স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দল দুটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বরাতে জানা গেছে, দলের নাম, নেতৃত্ব কাঠামো এবং সাংগঠনিক রূপরেখা- এই মৌলিক ইস্যুগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। ফলে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া থমকে আছে। এনসিপির নেতারা বলছেন, তারা নতুন রাজনৈতিক ধারার প্রতিফলন ঘটাতে চান, যেখানে গণঅধিকার পরিষদের পুরোনো কাঠামো ‘সময়োপযোগী নয়’। অপরদিকে, গণঅধিকার পরিষদের নেতারা মনে করছেন, নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতায় তাদের অবস্থান আলাদা এবং সেটি ছাড় দিতে তারা রাজি নন।

গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে এনসিপির একীভূতের ব্যাপারে গত ২২ সেপ্টেম্বর নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে এনসিপি প্রতিনিধি দলের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাবে এনসিপিা মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছিলেন, ‘যেহেতু রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তিনটি ব্লক হতে যাচ্ছে- একটি ইসলামিক ব্লক এরই মধ্যে হয়ে গেছে; বিএনপির নেতৃত্বে একটি ব্লক হচ্ছে; আর আমাদের নেতৃত্বে একটি ব্লক হচ্ছে।’ বিএনপি-জামায়াতের ব্লকে এনসিপি যাচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু বিএনপি না, এজন্য বিএনপির ব্লকেও যাচ্ছি না। আমরা যেহেতু জামায়াত না, এজন্য জামায়াতের ব্লকেও যাচ্ছি না। আমরা স্বতন্ত্র।’ গণঅধিকার পরিষদ এনসিপির সঙ্গে একীভূত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ‘হ্যাঁ’ বলেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, ‘কথাবার্তা চলছে; আমরা সম্মত হয়েছি। কী প্রক্রিয়ায় আসবে, এটা পলিসিগত জায়গা। আদর্শগত বিষয় স্পষ্ট করেছি। কয়েকটা আসন বা দেনাপাওনার বিষয় না; আদর্শিক লড়াই রয়েছে।’ এদিকে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোও এনসিপির কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কেউ কেউ অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগও শুরু করেছে বলে জানা গেছে। ফলে নির্বাচনের আগে জোট রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিপি যদি জামায়াতের সঙ্গে জোটে যায়, তাহলে একক সংসদীয় আসনে প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে এনসিপি নিজস্ব পরিচয় বজায় রেখে জোটের নির্বাচনি ফ্রেমওয়ার্কে অংশ নিতে পারবে- এমন একটি প্রস্তাব নিয়েই দু’পক্ষের মধ্যে প্রাথমিক যোগাযোগ চলছে। এনসিপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা নীতিগতভাবে স্বতন্ত্র থাকতে চাই, তবে নির্বাচনে কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করতেও জোটভিত্তিক কৌশল বিবেচনায় আছে। অন্যদিকে, জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ভোটভিত্তি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তবে এনসিপির শীর্ষ নেতারা এখনও প্রকাশ্যে কোনো জোটের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন। তারা আপাতত সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করার কাজ করছেন, পরবর্তী ধাপে রাজনৈতিক কৌশল ঘোষণা করবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যদি জোটে যায়, সেক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। কারণ, বিএনপির স্থানীয় নেতারা দীর্ঘ বছর জেল-জুলুম খেটেছেন। এনসিপির কোনো প্রার্থীর জন্য আসন ছেড়ে দিতে হলে বিএনপির স্থানীয় নেতারা স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এনসিপির এক নীতিনির্ধারণী নেতা বলেন, আমরা যে আসনগুলোতে প্রার্থী দিতে চাই, সেগুলো বিএনপির স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নামতে চাইবেন, যা জোটের ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তবুও জামায়াত নয়, বিএনপির সঙ্গেই সখ্য রাখার পক্ষে এনসিপির একাংশ। সম্প্রতি, বিএনপি ও এনসিপির মধ্যেই বেশি বাক্যবাণের ঘটনা ঘটছে। প্রায় প্রতিদিনই এক দলের নেতা অন্য দলের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর’ অভিযোগ আনছেন। দুই দলই একে অপরের অভিযোগ খণ্ডন না করে পালটা অভিযোগের তির ছুড়ছেন। তবে বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, এনসিপির সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। এনসিপি আলাদা জোট করলেও তাদের আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব বিএনপির।

একীভূতকরণের বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, এনসিপির কয়েকজন নেতাদের বক্তব্যের কারণে একীভূত হওয়া থমকে গেছে। আমি জানি না, আদৌ তা হবে কি না, তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে বসবো।’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘দুটি দল এক হয়ে গেলে সুষম বণ্টন হবে। হীনমন্যতার জায়গা থেকে এনসিপির কয়েকজন নেতারা একটা ইতিবাচক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য দিচ্ছে। এমনকি গণমাধ্যমের সামনে গণঅধিকার পরিষদকে নিয়ে নানান ধররে বিষদগার করেছে। তারা বলেছে, গণঅধিকার পরিষদের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা নাকি এনসিপিতে যোগ দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন। এমন মিথ্যাচার আমাদের কাছে খারাপ লেগেছে।’

এনসিপির সঙ্গে নির্বাচনি জোটের বিষয়ে রাশেদ বলেন, ‘দলটির সঙ্গে আমরা নির্বাচনি জোট করবো না। এই সম্ভাবনা একেবারেই জিরো। এনসিপি এত বড় দল না যে, তাদের সঙ্গে জোটে গিয়ে আমরা ক্ষমতার অংশীদার হতে পারবো। যদি তারা এখনও আন্তরিক থাকে, তাহলে আমরা উভয় মিলে একটি বড় দল হবো। সেক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত ইতিবাচক।’ এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘গণঅধিকার পরিষদ এনসিপিতে যোগ দেবে কী দেবে না, তা নিয়ে এরইমধ্যে আমরা পার্টির বৈঠকে আমরা অনেক ধরনের কথা বলেছি। এখানে অনেক ইতিবাচক দিক ছিল, নেতিবাচক অনেক বিষয় নিয়েও কথা হয়েছে। এটা এখনও একটা প্রাথমিক আলোচনার পর্যায়ে। যেহেতু আমরা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি, এ কারণে এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করার সুযোগ তৈরি হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মধ্যপন্থি যে দলগুলো রয়েছে, তাদের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া কিংবা নির্বাচনি জোট যদি তৈরি হয়, তাহলে সবার জন্য ওপেন প্লেস। সেটা গণঅধিকার পরিষদ হতে পা আবার যে কোনো দলও হতে পারে।