চোখে অশ্রু মুখে হাসি নিয়ে ঘরে ফিরছেন গাজাবাসী
* গতকাল গাজাসিটিতে ফিরলেন ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি * যুদ্ধবিরতিকে ফিলিস্তিনের ‘বড় বিজয়’ হিসেবে দেখা হচ্ছে * গাজা ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধার * যুদ্ধবিরতি তদারকি করতে ইসরাইলে মার্কিন সেনা দল
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
‘আজ আমরা আঘাত ও শোক নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরছি, তবুও যে আমরা ফিরতে পারছি সে জন্য মহান আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ’। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার দক্ষিণ খান ইউনিসে বার্তা সংস্থা এএফপিকে এসব কথা বলেন ৩২ বছর বয়সি আমীর আবু ইয়াদে। গত শুক্রবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় দুপুরের পর গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। এরপরই লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের নিজ আবাসভূমি উত্তর গাজায় ফিরতে শুরু করেছে। ঘরে ফেরা বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একজন ৩৯ বছর বয়সি মোহাম্মদ মরতাজা। বলেন, ‘প্রার্থনা করি গাজায় ফিরে যেন আমার বাড়ি যেন অক্ষত দেখতে পাই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি যুদ্ধ চিরতরে শেষ হবে, যাতে আর কখনও আমাদের পালাতে না হয়।’ গাজা যুদ্ধের শুরুতেই গৃহহারা হন ৫৩ বছর বয়সি আরিজ আবু সাদাহে। অবশেষে নিজ বাড়িতে ফিরছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি শান্তি ও যুদ্ধবিরতির জন্য খুশি। যদিও আমি এমন একজন মা যার এক ছেলে ও এক মেয়ে মারা গেছে,তাদের জন্য আমি গভীরভাবে শোকাহত। তবুও, যুদ্ধবিরতি কিছু আনন্দও নিয়ে এসেছে: আমাদের বাড়িতে ফেরার আনন্দ।’
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গত শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার বিকাল ৩টা) যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়েছে। এর রূপরেখা অনুযায়ী ইসরাইলি সেনারা এখন বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় আটক ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে; বিনিময়ে ইসরাইলে বন্দি শত শত ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
শনিবার গাজা নগরীতে ফিরলেন ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি : ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় দিনে হাজারো বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি গাজা নগরে ফিরতে শুরু করেছেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহরে ফিরে কেউ হতবাক ধ্বংসযজ্ঞে, কেউ বা স্বস্তি পেয়েছেন। যুদ্ধবিরতির সুযোগে রাজা সালমি নামের এক ফিলিস্তিনি নারী পায়ে হেঁটে ফিরে গেছেন গাজা নগরের নিজের বাড়িতে। কয়েক সপ্তাহের বিমান ও স্থল অভিযানে ওই অঞ্চলে তীব্র বোমাবর্ষণ হয়েছিল—যেখানে ইসরাইলি বাহিনীর দাবি অনুযায়ী হাজারো হামাস যোদ্ধা অবস্থান করছিল। রাজার ভাষায়, ?‘আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেছি। প্রতিটি পদক্ষেপে ভয় ও উৎকণ্ঠা ছিল—বাড়িটা আদৌ আছে কি না।’ তিনি যখন আল-রিমাল পাড়ায় পৌঁছান, দেখেন তার ঘরটি আর নেই। ‘এটা আর কোনো ঘর নয়- শুধু ধ্বংসস্তূপ। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে কেঁদেছি। আমার সব স্মৃতি এখন শুধু ধুলো,’ বলেন সালমি। হামাস-নিয়ন্ত্রিত বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, শনিবার একদিনেই প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গাজা নগরে ফিরেছেন। সংস্থার কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-মুগাইয়ির বলেন, ‘গতকাল (শুক্রবার) থেকে এখন পর্যন্ত মোট প্রায় আড়াই লাখ মানুষ গাজা নগরে ফিরে এসেছেন।’
গাজা যুদ্ধবিরতি কেন ‘বড় বিজয়’ হিসেবে গণ্য হচ্ছে : গাজায় গণহত্যার তৃতীয় বছরের শুরুতে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে এবং মিশর, তুরস্ক, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে।
এই চুক্তি নানা কারণে হামাসের জন্য বড় বিজয় এবং দখলদার ইসরাইলের জন্য পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসরাইল গত দুই বছর ধরে হামাসকে ধ্বংস ও গাজা দখলের লক্ষ্য নিয়ে নজিরবিহীন গণহত্যা চালিয়েছে। কিন্তু দুই বছর পরও হামাস টিকে আছে এবং শেষ পর্যন্ত ইসরাইলকেই হামাসের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হতে হয়েছে।
অন্যদিকে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজায় শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের ঢেউও শুরু হয়েছে। এর ফলে গাজার জনগণকে জোরপূর্বক স্থানান্তর এবং পুরো গাজা অঞ্চল দখলের পরিকল্পনাও কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তির কিছু ধারা হামাসের জন্য বিশেষ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যেমন- ২০ জন ইসরাইলি বন্দির বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবেন, যাদের মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। দখলদার ইসরাইল এই শর্তটি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে, কারণ নেতানিয়াহু দুই বছর যুদ্ধ চালিয়েও সামরিক উপায়ে বন্দিদের মুক্ত করতে পারে নি এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক চুক্তির পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী ইসরাইলি সেনারা গাজায় দখলকৃত অঞ্চলগুলো থেকে সরে যাবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, কারণ নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রিসভা গাজার পূর্ণ দখলকেই তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো — গাজার প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের হাতে থাকবে। ইসরাইলের ভেতরে নেতানিয়াহুর সমালোচকরা মনে করেন, এই সিদ্ধান্তের অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল কার্যত একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে। সমালোচকদের মতে, এটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার একটি ঐতিহাসিক সাফল্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হামাসকে নিরস্ত্র করা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এ দাবি তুললেও এ বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেছেন, ‘হামাস কখনো তার অস্ত্র ত্যাগ করবে না; এই অস্ত্র ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার জন্য।’
তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল বিশ্বাসযোগ্য কোনো পক্ষ নয়, তাদেরকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। তারা ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তির পর আবারও হামাস ধ্বংস ও গাজা দখলের উদ্দেশ্যে নতুন যুদ্ধ শুরু করতে পারে।যদিও এই অবিশ্বাস ও অনাস্থা যৌক্তিক এবং অতীত অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত। আর ইসরাইল যদি চুক্তি ভঙ্গ করে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে বড় আঘাত হানবে।
অন্যদিকে, এর ফলে হামাসের সামরিক সক্ষমতায় কোনো প্রভাব পড়বে না, কারণ তারা এখনো নিরস্ত্র নয় এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারবে। সবশেষে বলা যায়, গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল সেই অক্টোবর মাসেই— ঠিক যেমন ‘আল-আকসা তুফান’ অভিযানও ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হয়েছিল। তবে এই যুদ্ধের সমাপ্তিটা ইসরাইলের সামরিক বিজয়ের মধ্যদিয়ে ঘটেনি বরং গাজার জনগণের অদম্য প্রতিরোধ ও ঐক্যের ফলে এই যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হামাসের প্রভাবশালী নেতা মাহমুদ মারদাওয়ি বলেছেন, ‘গাজা তার ঐক্য ও দৃঢ?তার মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছে এবং জবরদস্তি ও দখলদার শক্তির ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধবিরতি কারও দয়া নয়; এটি আমাদের জনগণের কিংবদন্তিতুল্য ধৈর্য বিশেষ করে গাজার মুজাহিদদের ত্যাগ ও বীরত্বের ফসল, যারা ৭ অক্টোবরের বীরত্বগাথা রচনা করেছে।’
গাজা ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধার : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লাশ উদ্ধার শুরু হয়েছে। বোমাবর্ষণ বন্ধ ও ইসরাইলি সেনারা সরে যাওয়ার পর উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা মরদেহ উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, শুক্রবার গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৫৫টি লাশ আনা হয়। যারমধ্যে ১৩৫টি মরদেহ ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করা হয়েছে।
ওয়াফার তথ্য অনুযায়ী, ৪৩টি লাশ পাঠানো হয়েছে গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালে। ৬০টি মরদেহ একই অঞ্চলের আল-আহলি আরব হাসপাতালে, চারটি নুসেইরাতের আল-আওদা হাসপাতালে, ১৬টি দেইর-এল-বালা’র আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে এবং ৩২টি লাশ খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দখলদারদের হামলায় নতুন করে ১৯ জন নিহত হয়েছেন। আরেকজন আহত অবস্থায় প্রাণ হারান। এরমধ্যে গাজা সিটির দক্ষিণাঞ্চলে শুক্রবার ভোরে ঘাবুন পরিবারের ওপর চালানো হামলায় একসঙ্গে ১৬ জন নিহত হন। এছাড়া গাজা সিটির রাদওয়ান এলাকায় একজন এবং খান ইউনিসে আরও দুজন নিহত হন।
যুদ্ধবিরতি তদারকি করতে ইসরাইলে মার্কিন সেনা দল : গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার তদারকি মিশনের অংশ হিসেবে মার্কিন সেনারা ইসরাইলে পৌঁছাতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে এবিসি নিউজ।
প্রতিবেদনে মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে প্রায় ২০০ সদস্যের একটি দল এই সপ্তাহান্তে ইসরাইলে পৌঁছাবে। এরই মধ্যে মার্কিন সেনা সদর দপ্তরের (সেন্টকম) প্রধান অ্যাডমিরাল ব্র্যাড কুপার বৃহস্পতিবার ইসরাইলে পৌঁছেছেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মার্কিন সেনারা গাজা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের জন্য একটি যৌথ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র গঠনে সহায়তা করবে। তারা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর (আইডিএফ) সঙ্গে সমন্বয় করে অন্যান্য দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কার্যক্রমও একীভূত করার দায়িত্বে থাকবেন। তবে কোনো মার্কিন সেনা গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করবে না বলে নিশ্চিত করেছেন কর্মকর্তারা।এই মিশনে মিশর, কাতার, তুরস্ক এবং সম্ভাব্যভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক কর্মকর্তারাও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। দলটির কেন্দ্র পরিচালিত হবে মিশর থেকেই।
