গাজার টানেল গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ইসরায়েলের
* ট্রাম্পে আস্থা : গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে হামাস কি জুয়া খেলছে * ইসরায়েল গাজার চুক্তি মানবে, এটা বিশ্বাস করি না : ইরান * গাজা থেকে সেনা সরিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েল * ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তির দিনক্ষণ জানাল হামাস
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
গাজা থেকে জিম্মিরা মুক্ত হওয়ার পরপরই সেখানকার ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের অবশিষ্টাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদনে এই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আজ রোববার ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এ কথা বলেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, যে দেশটির উদ্যোগে তিন দিন আগে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে, সেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একটি ‘আন্তর্জাতিক’ তদারকিতে এই অভিযান চলবে। এক বিবৃতিতে কাৎজ বলেছেন, ‘জিম্মিদের মুক্তি পাওয়ার ধাপটি শেষ হলে ইসরায়েলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জটি হবে গাজায় হামাসের সব সুড়ঙ্গ ধ্বংস করা। এ অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুত থাকতে আমি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি।’
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস গাজায় ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। এ ধরনের সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ইসরায়েলের গোয়েন্দা নজরদারির বাইরে থেকে কাজ করার সুযোগ পায় তারা। এর মধ্যে কিছু সুড়ঙ্গ সীমানার বেড়ার নিচ দিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েছে। এগুলো ব্যবহার করে ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালানোর সুযোগ পায় হামাস। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস সীমান্ত পার হয়ে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে হামলা চালায়। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এর পর থেকে দুই বছর ধরে ইসরায়েলি হামলা চালিয়ে বেশ কিছু সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে দিয়েছে।
কাৎজ বলেছেন, হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ ও সংগঠনটির সামরিক ক্ষমতা কমানোর রূপরেখা অনুযায়ী বাকি সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করা হবে। গাজায় যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। হামাস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত পরিকল্পনার প্রথম ধাপ মেনে নিয়েছে। এর আওতায় গত শুক্রবার থেকে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আজ সোমবার ৪৮ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। এর মধ্যে যারা জীবিত আছেন, তাদের জীবিত অবস্থায় তুলে দেওয়া হবে। আর যারা নিহত হয়েছেন, তাদের লাশ হস্তান্তর করা হবে।
ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল ২৫০ জন কারাবন্দিকে মুক্তি দেবে। এর মধ্যে প্রাণঘাতী হামলার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া কয়েকজন ব্যক্তিও আছেন। গাজা থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হাতে আটক হওয়া ১ হাজার ৭০০ জন ফিলিস্তিনিও মুক্তি পাবেন। তবে হামাস এখনও পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণের জন্য রাজি হয়নি। গতকাল রোববার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হোসাম বাদরান বলেছেন, মার্কিন পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে অনেক জটিলতা এবং সমস্যার বিষয় আছে।
ট্রাম্পে আস্থা-গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে হামাস কি জুয়া খেলছে : ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একসময় ‘বর্ণবাদী’, ‘অরাজকতার রেসিপি’ এবং গাজা নিয়ে ‘অযৌক্তিক কল্পনা’ পোষণকারী ব্যক্তি বলে আখ্যা দিয়েছিল। তবু গত মাসে এক অবিশ্বাস্য ফোনকল হামাসকে এই বিশ্বাসে রাজি করিয়েছে যে, যুদ্ধের জিম্মিদের সবাইকে ছেড়ে দিলেও ট্রাম্প ইসরায়েলকে শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করতে পারবেন। এমনটাই জানিয়েছেন দুই ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা। ওই ফোনকলটি গত সেপ্টেম্বরের ঘটনা। ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এক বৈঠকের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সঙ্গে নিয়ে কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দেন। উদ্দেশ্য ছিল- দোহায় হামাসের রাজনৈতিক নেতাদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত একটি আবাসিক কমপ্লেক্সে ইসরায়েলি হামলার জন্য ক্ষমা চাওয়া।
কাতারে ওই হামলায় মূল লক্ষ্যবস্তুদের কেউ নিহত হয়নি। ওই বাসভবনে হামাসের প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়াও ছিলেন। কিন্তু এই ঘটনায় ট্রাম্পের ভূমিকা হামাসের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে যে, তিনি নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে পারেন এবং গাজা যুদ্ধ থামাতে তিনি সত্যিই আগ্রহী।
এরপর, গত বুধবার ট্রাম্প-সমর্থিত এক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে হামাস। তাতে তারা আবারও বিশ্বাস রেখেছে সেই মানুষটির ওপর, যিনি চলতি বছর গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেটিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে একটি সমুদ্র-রিসোর্ট বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
চুক্তি অনুযায়ী, গত শুক্রবার থেকে কার্যকর হওয়া এই যুদ্ধবিরতিতে হামাস জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। বিনিময়ে গাজা থেকে ইসরায়েলি পূর্ণ প্রত্যাহারের কোনো নিশ্চয়তা তারা পায়নি। হামাসের দুই কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, এটি বড় ধরনের এক ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। এর পুরোটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ওপর; তিনি যেন চুক্তি ভেস্তে যেতে না দেন।
এক হামাস কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সংগঠনটি জানে তাদের এই ঝুঁকি উল্টো ফলও দিতে পারে। তাদের আশঙ্কা, জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার পর ইসরায়েল আবারও সামরিক অভিযান শুরু করতে পারে- যেমনটা হয়েছিল জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির পর, যে চুক্তিতেও ট্রাম্পের দল ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল।
তবুও মিসরের শারম আল-শেখে ইসরায়েলের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায় অংশ নিতে যাওয়া হামাস নেতারা যথেষ্ট আশ্বস্ত বোধ করেন। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং আঞ্চলিক শক্তিধর দেশগুলোর উপস্থিতি তাদের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে উদ্বুদ্ধ করে—যদিও এতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ তাদের বহু গুরুত্বপূর্ণ দাবি অপূর্ণ রয়ে গেছে।
হামাসের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘ওই কনফারেন্স সেন্টারে ট্রাম্পের আগ্রহ খুব স্পষ্ট ছিল।’ এক মার্কিন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, ওই ম্যারাথন বৈঠকের সময় ট্রাম্প নিজে তিনবার ফোন করেন। তাঁর জামাতা জ্যারেড কুশনার ও দূত স্টিভ উইটকফ ইসরায়েলি ও কাতারি আলোচকদের মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন।
এই চুক্তি যুদ্ধের অবসান ঘটানোর পথ তৈরি করতে পারে- যা শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের মাধ্যমে। তবে ট্রাম্পের ঘোষিত ২০ দফা গাজা পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলো আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা অনিশ্চিত। তবে কাতার হামলা ও জুনে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধ বন্ধে ভূমিকাণ্ডদুই ঘটনাতেই ট্রাম্পের দৃঢ় পদক্ষেপ হামাস নেতাদের মনে করেছে, তিনি জিম্মি মুক্তির পরও ইসরায়েলকে যুদ্ধ চালাতে দেবেন না। এমন মন্তব্য করেছেন দুই ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা এবং আলোচনায় যুক্ত এক সূত্র।
ওয়াশিংটনের এক সূত্র জানিয়েছে, কাতার হামলা নিয়ে নেতানিয়াহুর ওপর ট্রাম্পের ক্ষোভই তাঁর দলের কাছে এক সুযোগ তৈরি করে—যা কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলকে শান্তিচুক্তির কাঠামোয় আনতে চাপ দেওয়া হয়। এক হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা জানান, ট্রাম্প উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন এবং কাতারের আমিরকে ব্যক্তিগতভাবে বন্ধু মনে করেন। তাই টেলিভিশনে হামলার ছবি দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। ওই হামলাকে তিনি ‘আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মোড় ঘোরানো মুহূর্ত’ হিসেবে দেখেছিলেন।
ট্রাম্প প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে, কাতারে আর কোনো ইসরায়েলি হামলা হতে দেওয়া হবে না। হামাসসহ অন্যান্য আঞ্চলিক পক্ষের চোখে এতে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। গাজার এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনি কাতারকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন- এতে হামাসের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, যুদ্ধবিরতি টিকে থাকবে।’
ইসরায়েলের বার-ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোনাথন রেইনহোল্ড বলেন, ‘এই নিশ্চয়তা হামাসের আস্থা বাড়িয়েছে।’ গাজার আরেক কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্প ইরান ও ইসরায়েল উভয়কেই যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন, যা হামাস গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে। জুনে ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধের সময় ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ইসরায়েলি বিমান হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘তাদের বিমানগুলো ঘুরে গিয়ে ঘরে ফিরে আসুক।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘নাটকীয় হলেও ট্রাম্প যা বলেন তা করেন।’ এতে হামাসের ধারণা হয়, তিনি ইসরায়েলকেও যুদ্ধবিরতি মানতে বাধ্য করতে পারেন। তবে হামাস জানে, এই বাজি উল্টেও যেতে পারে। জানুয়ারির যুদ্ধবিরতিতে ধাপে ধাপে জিম্মি মুক্তি ও ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের কথা ছিল। কিন্তু প্রক্রিয়ার মাঝেই ট্রাম্প ঘোষণা দেন- হামাস যেন একসঙ্গে সব জিম্মি ছেড়ে দেয়, নইলে তিনি চুক্তি বাতিল করবেন এবং ‘নরক নেমে আসবে’। ফলে সেই চুক্তি ভেস্তে যায়। এর পরের যুদ্ধেই গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসেবে ১৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন, ইসরায়েলি অবরোধে খাদ্য সহায়তা বন্ধ হয়ে যায় এবং বৈশ্বিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষক সংস্থা গাজাকে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল ঘোষণা করে।
এক আঞ্চলিক কূটনীতিক বলেন, ইসরায়েল হয়তো আবারও হামাসকে টার্গেট করতে প্রলুব্ধ হতে পারে- বিশেষ করে যদি হামাস বা তার সহযোগী গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলে রকেট হামলার মতো পদক্ষেপ নেয়। তবে এবারের পরিস্থিতি আগের যুদ্ধবিরতি থেকে আলাদা বলে মনে করছেন হামাস কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ইসরায়েল এবার আন্তরিকভাবে চুক্তিতে আসছে এবং মিশর, কাতার, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দুই পক্ষকেই আলোচনায় রাখছে।
চুক্তি বাস্তবায়নে আরও গতি আনবে ট্রাম্পের আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফর- যা শুরু হবে রোববার থেকে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির আমন্ত্রণে তার এই সফরকে এক আলোচনা সূত্র বলেছেন ‘অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।’
ইসরায়েল গাজার চুক্তি মানবে- এটা বিশ্বাস করি না -ইরান : ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস অরাগচি বলেছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার এক দিন পরও দখলদার ইসরায়েল এই চুক্তির শর্ত পালন করবে বলে কোনো আস্থা নেই আমাদের। তিনি বলেন, ইসরায়েলের পূর্বের চুক্তি এবং আগ্রাসনবিরতি নিয়ে আমরা সজাগ। জায়োনিস্ট শাসক ধোঁকা ও প্রতারণা করতে পারে। এই শাসকের প্রতি কোনো আস্থা নেই। তিনি লেবাননে পূর্বের আগ্রাসনবিরতির লঙ্ঘনের উদাহরণও উল্লেখ করেন এ সময়। তবে অরাঘচি আগ্রাসনবিরতির প্রতি ইরানের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, যে কোনো পরিকল্পনা যা এই অপরাধ থামাতে সাহায্য করবে, তাতে আমাদের সবসময় সমর্থন রয়েছে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, ইরান যে কোনো পদক্ষেপ বা উদ্যোগকে সমর্থন করেছে, যা গণহত্যামূলক যুদ্ধ থামানো, দখলদার বাহিনী প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া, ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি এবং ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের অন্তর্ভুক্ত।
ইরান ও ইসরায়েল জুনে ১২ দিনের যুদ্ধ করেছে, যা শুরু হয়েছিল ইসরায়েলের ইরানের নিউক্লিয়ার ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে অভূতপূর্ব হামলার মাধ্যমে।
অরাঘচি জানান, রাশিয়ার মাধ্যমে ইরানকে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে ইসরায়েল ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে নতুন কোনো সংঘাত চায় না। তিনি বলেন, মোটামুটি তিন-চার দিন আগে নেতানিয়াহু ও পুতিনের মধ্যে একটি টেলিফোন আলাপ হয়েছিল। নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে বলেছেন, ইরানের সঙ্গে নতুন যুদ্ধ শুরু করার কোনো ইচ্ছা নেই। এই বার্তাটি পরে তেহরানের রাশিয়ান দূতাবাসের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
গাজা থেকে সেনা সরিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েল : যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে ইসরায়েল। এরইমধ্যে কয়েকটি এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েল-গাজা সীমান্তের ‘ইয়েলো লাইন’ ক্রসিং দিয়ে সেনাদের ফিরিয়ে আনা শুরু হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত গাজার মধ্যাঞ্চলীয় শহর গাজার সিটির শেজাইয়া, আল তুফাহ এবং জেইতুন এলাকা, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসের পূর্বাংশ এবং দক্ষিণাংশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পর্যায়ক্রমে গাজার অন্যান্য এলাকা থেকেও সেনাদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
এদিকে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর নিজ বাসভূমি ফিরে আসছেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। শুক্রবার থেকে শনিবার পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ ফিলিস্তিনি গাজা সিটিতে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছে উপত্যকাটির সিভিল ডিফেন্স সংস্থা। গত কয়েক সপ্তাহের ভারি বোমাবর্ষণে এলাকাটি এমন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে যা সেখানকার মানুষ কল্পনাও করেননি। তবুও তারা নিজের এলাকায় ফিরে যাচ্ছেন।
প্রায় দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে গত মাসের শেষের দিকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসেন ট্রাম্প। এর সপ্তাহ খানেক পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন তিনি।
ট্রাম্পের ওই ২০ দফা প্রস্তাব নিয়ে গত সোমবার মিশরের পর্যটন শহর শারম আল-শেখে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় হামাস ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের পরোক্ষ আলোচনা শুরু হয়। টানা তিনদিনের মাথায় গত বুধবার দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রস্তাবের প্রথম ধাপ মানতে সম্মত হয় দুই পক্ষ। গত শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতি অনুমোদন করে ইসরাইলি সরকার এবং এদিনই গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর ও সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়েছে বলে জানায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ)।
ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তির দিনক্ষণ জানাল হামাস : দীর্ঘ দুই বছরের মাথায় অবশেষে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে গাজা উপত্যকায়। চুক্তি অনুযায়ী কিছু ইসরায়েলি বন্দির মুক্তির বিনিময়ে বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি দেবে দখলদার ইসরায়েল। এরই প্রেক্ষিতে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তির দিনক্ষণ জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানিয়েছে, গত সোমবার সকাল থেকে গাজায় আটক থাকা ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি প্রক্রিয়া শুরু হবে। গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা মেহের।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপের অংশ হিসেবে এই বন্দি বিনিময় কার্যক্রম শুরু হবে। এ প্রক্রিয়ায় হামাস প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেবে বলে ধারণা করছে ইসরায়েল। এ বিষয়ে হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ওসামা হামদান শনিবার ফরাসি সংবাদসংস্থা এএফপি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়া সোমবার সকালে শুরু হবে, যেমনটি উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছিল।’
একই দিন (সোমবার) বিকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি লোহিত সাগর তীরবর্তী পর্যটন নগরী শারম আল-শেখে ২০টিরও বেশি দেশের অংশগ্রহণে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের নেতৃত্ব দেবেন বলে জানিয়েছে মিশরীয় প্রেসিডেন্টের কার্যালয়।
এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই বৈঠকের লক্ষ্য হবে ‘গাজা উপত্যকায় যুদ্ধের অবসান, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা জোরদার করা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা করা।’
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উপস্থিত থাকবেন কি না, সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে হামাস জানিয়েছে, তারা সম্মেলনে অংশ নেবে না, কারণ আলোচনার পুরো প্রক্রিয়ায় তারা ‘মূলত কাতারি ও মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে’ অংশ নিয়েছে। এমনটাই জানান হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য হোসাম বদরান।
