ছাত্র সংসদ নির্বাচন

চাকসুতে প্রতীক্ষার ভোট আজ

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

দীর্ঘ ৩৫ বছর পরে আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চাকসু নির্বাচন। চবিয়ানদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রধান প্লাটফর্ম চাকসু। এখান থেকেই যুগে যুগে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষকে পথ দেখিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে মাত্র ৬ বার চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে ৯০৭ জন প্রার্থী এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রার্থীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ৪১৫ জন, হল ও একটি হোস্টেল সংসদে ৪৯২ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৮ জন নারী প্রার্থী ও ৩৬৬ জন পুরুষ প্রার্থী। এবারের নির্বাচনে ভোটার ২৭ হাজার ৫১৭ জন। এরমধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৪৩৪ জন।

নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ৬০টি কক্ষের প্রতিটিতে গড়ে ৪০০-৫০০ শিক্ষার্থী ভোট দেবেন। নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রতিটি অনুষদ ভবনের ডিনকে রিটার্নিং অফিসার এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার থেকে শিক্ষার্থী ছাড়া বহিরাগত কেউ ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারছেন না। এরই মধ্যে ভোটের দিনের নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় এসব নির্দেশিকা প্রকাশ করে চাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন।

ক্যাম্পাসে প্রবেশ ও পরিচয় যাচাই : ভোটারদের ক্যাম্পাসে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত প্রবেশপয়েন্ট যেমন: কাটা পাহাড় (বাণিজ্য অনুষদের সামনে), ৩ নং গোডাউন (প্রফেসর ইউনূস ভবনের পূর্বপাশে), শহীদ মিনারের দক্ষিণের আর্চওয়ে (লেডিস ঝুপড়ির সামনে) ব্যবহার করতে হবে। ক্যাম্পাসে প্রবেশের সময় সকল শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় আইডি কার্ড সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ভ্যালিড ব্যাংক পে-স্লিপ দেখিয়েও প্রবেশ করতে পারবেন।

ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ ও ব্যালট গ্রহণ : নির্দিষ্ট ভবনের সামনের ব্যারিকেডে ভ্যালিড আইডি কার্ড দেখিয়ে মূল ফটক পার হতে হবে; ভোটারদের চাকসুর ওয়েবসাইট থেকে আগে থেকেই নিজের ভোট কক্ষের নাম ও কেন্দ্রের অবস্থান জেনে নিতে হবে; প্রার্থীরা নিজ হলের কেন্দ্রে নিয়মমাফিক ভোট দেওয়ার পর পুনরায় নির্বাচনি কেন্দ্রে (বহিঃস্থ ব্যারিকেডের ভেতর) প্রবেশ করতে পারবেন না; কক্ষে প্রবেশের পর আইডি কার্ড ছবিযুক্ত ভোটার তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার পর নির্বাচন কর্মকর্তা স্বাক্ষর করে মোট পাঁচটি ব্যালট পেপার প্রদান করবেন। ভোটপ্রদানের বিষয়ে বলা হয়, ব্যালট-১ থেকে ব্যালট-৪ কেন্দ্রীয় চাকসু নির্বাচনের জন্য এবং ব্যালট-৫: নিজ নিজ হল সংসদের নির্বাচনের জন্য।

গোপন কক্ষে ভোট প্রদানের পদ্ধতি : পাঁচটি ব্যালট নিয়ে নির্ধারিত গোপন কক্ষে প্রবেশ করতে হবে এবং কক্ষে রাখা নির্ধারিত পেন ব্যবহার করে পছন্দের প্রার্থীর নামের পাশের বৃত্ত সম্পূর্ণভাবে ভরাট করতে হবে।

ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নিয়মাবলী অনুসরণীয়: প্রতিটি পদের জন্য সাধারণত একটি করে বৃত্ত ভরাট করতে হবে; চাকসুতে নির্বাহী সদস্য পদে সর্বোচ্চ ৫টি, হল সংসদে সর্ব্বোচ্চ ৩টি এবং হোস্টেল সংসদে সর্বোচ্চ ৩টি ভোট প্রদান করা যাবে; কোনো পদের জন্য নির্ধারিত সংখ্যার বেশি বৃত্ত ভরাট করলে শুধুমাত্র সেই পদের ভোটটি বাতিল হবে; অন্যান্য পদের ভোট বৈধ থাকবে; ব্যালট জমা দেওয়া ও কেন্দ্র ত্যাগ করতে হবে; ভোট সম্পন্ন করার পর গোপন কক্ষ থেকে বের হয়ে নিজ হাতে নির্দিষ্ট ব্যালটবাক্সে ব্যালট ফেলতে হবে।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা : ভোটগ্রহণ চলাকালীন সময়ে নির্বাচন কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্ট, রোভার স্কাউট ও নিরাপত্তা সদস্যদের প্রতি অনুশাসিত ও সুশৃঙ্খল আচরণ করার অনুরোধ জানানো হলো; কেন্দ্রের ভিড় কম থাকলে নিজ হলের ভোটাররা আইডি কার্ড ও অফিসিয়াল ড্রেস দেখিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে লাইন ছাড়া ভোট দিতে পারবেন; ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে কোনো রকম চাপ, প্রলোভন বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। এবিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর বলয়ে সাজিয়েছি আমাদের পুরো ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই ভোট প্রদান করতে পারবে।’

ছাত্রদল ভিপি প্রার্থীর প্রতিশ্রুতি- নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্যাম্পাস : ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল থেকে ভিপি পদে লড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়। ছাত্রদল নির্বাচিত হলে তারা সন্ত্রাস ও ভয়ভীতিমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের জন্য আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলছে। সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় বলেন, ‘নির্বাচনের আট দফা ইশতেহারে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ, সেশনজট নিরসন, প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণ এবং আধুনিক ক্যাম্পাস গড়ার লক্ষ্য।’

কেন্দ্রীয় সংসদে ৪১৫ জন, হল ও একটি হোস্টেল সংসদে ৪৯২ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৮ জন নারী প্রার্থী ও ৩৬৬ জন পুরুষ প্রার্থী। এবারের নির্বাচনে ভোটার ২৭ হাজার ৫১৭ জন। এরমধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৪৩৪ জন। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ৬০টি কক্ষের প্রতিটিতে গড়ে ৪০০-৫০০ শিক্ষার্থী ভোট দেবেন। তিনি বলেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ভাতা বৃদ্ধি, হলে আসন সংরক্ষণ, ব্রেইল বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করব। এছাড়া খাদ্য ও আবাসন খাতে ক্যান্টিনে ভর্তুকি বৃদ্ধি, খাবারের মান যাচাই কমিটি গঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ক্যাম্পাসে রূপান্তর করার কথা বলেছে এ নেতা। তাদের লক্ষ্য, ‘প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি সিট, একটি পড়ার টেবিল’ নিশ্চিত করা।

নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ফোকাস রাখার কথা বলেছেন এই নেতা। ছাত্রদল তাদের ইশতেহারে নারীদের পোশাক ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স; প্রতি হলে স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন; নারী চিকিৎসক এবং নিরাপদ কমনরুম সুবিধা; ইনডোর স্পোর্টস সুবিধা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ছাত্রদলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল সাংগঠনিক দুর্বলতা। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় এবং সংগঠনের ভেতরে মতবিরোধ থাকার কারণে, অনেক প্রার্থী শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিচিত। এছাড়া গত রবিবার সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগের কারণে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন উর রশীদ মামুনকে। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের মধ্যে এক ধরনের কোন্দলও দেখা গেছে।

হৃদয় আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শতভাগ আবাসনের ব্যবস্থা করতে চাই। ভর্তির প্রথম দিন থেকেই প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি আসন ও একটি পড়ার টেবিল নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, শাটল ট্রেনে বগি সংকট, পাওয়ার কার বিকল- এগুলোও সমাধান করতে হবে।’ শহর ও উপজেলা পর্যায়ে বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

শিক্ষার্থীদের আমানত রক্ষা করার অঙ্গীকার শিবির প্যানেলের ভিপি প্রার্থী রনির : ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ৯টি ফোকাস পয়েন্ট দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি তারা আরও ৩৩টি দফা দিয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত চাকসু নির্বাচন নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ বাস সার্ভিস চালু, সেশনজট নিরসন, কটেজ-মেসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সুবিধা বৃদ্ধি, ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস গঠনের কথা বলা হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ও নারীবান্ধব কমনরুম চালু, নিরাপদ ও গ্রিন ক্যাম্পাস নির্মাণ, সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, লিগ্যাল এইড সেল গঠনের মতো প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।

এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণ শিবিরের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন মত, পথ ও চিন্তার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। আমি নির্বাচিত হলে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে কাজ করব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব, পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেব এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখব।’

চাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি বেছে নেয়। নির্বাচিত হলে প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক আরও মজবুত করব। প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করব।’

অন্যান্য প্যানেল বা প্রার্থীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে রনি বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার প্রতিপক্ষ নয়; তারা আমার সহপাঠী ও বন্ধু। আমরা সবাই মিলেমিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ক্যাম্পাসকে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ নেব। ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসিটিভি স্থাপন, রাস্তার বাতি মেরামত, আবর্জনামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত এবং নারীদের নিরাপত্তা জোরদারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই চাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটুক। ছাত্রসমাজ যেন তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে প্রশাসনিক সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেব। শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য প্রশাসনিক সেবা নিশ্চিত করব। আমার অঙ্গীকার হলো- আমি কোনো প্রভাব বা চাপের কাছে নতি স্বীকার করব না। শিক্ষার্থীদের ভোটই আমার শক্তি, আর আমি সেই ভোটের আমানত রক্ষা করব।’

শিক্ষার্থীদের বিভাজন দূর করতে চান মাহফুজুর রহমান : ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে ভিপি পদে লড়বেন মাহফুজুর রহমান। তিনি ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) যুগ্ম আহ্বায়ক। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) থেকে সরে এসে স্বতন্ত্র প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান প্যানেলের প্রার্থীরা। মাহফুজ বলেন, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় ও সমস্যা সমাধানই তার প্রধান লক্ষ্য। তিনি মনে করেন, চাকসু শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবহন সংকট, আবাসন সমস্যা ও শিক্ষার পরিবেশকে অগ্রাধিকার দেবেন এবং নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এসব সমস্যার সমাধানে কাজ করবেন। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা জরুরি। ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের অনিয়ম, বৈষম্য বা ভীতিকর পরিবেশ যেন না থাকে- সেটি নিশ্চিত করতে তিনি উদ্যোগ নেবেন। মাহফুজ নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া বিভাজন দূর করে একত্রিত, ঐক্যবদ্ধ ক্যাম্পাস গঠনে মনোযোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন।

ভোটযুদ্ধে ব্যবধান গড়ে দেবেন ছাত্রীরা : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে এবার ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন ২৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছাত্রী সাড়ে ১১ হাজার। অর্থাৎ মোট ভোটারের প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। এই বিপুল ভোটার ঘিরে এখন প্রার্থীদের সব হিসাব-নিকাশ, কৌশল আর আশাবাদ। এককথায়, ভোটযুদ্ধে ছাত্রীরাই গড়ে দিতে পারেন ব্যবধান।

ক্যাম্পাসে গত ১৯ দিন প্রচার চলেছে জোরেশোরে। ঝুপড়ি, শাটল ট্রেন, হল-কটেজ কিংবা অনুষদের সিঁড়ি-সব জায়গাতেই দেখা মিলেছে প্রার্থীদের। প্রচারপত্র ও ইশতেহার নিয়ে তারা ঘুরে বেড়িয়েছেন। ভোট চেয়েছেন। গত সোমবার রাত ১২টায় শেষ হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রচার।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হলের সংখ্যা ৫। সব মিলিয়ে আবাসন রয়েছে ২ হাজার ৫৮২ জনের। তবে গাদাগাদি করে হলে থাকেন সাড়ে ৩ হাজারের মতো ছাত্রী। বাকি শিক্ষার্থীরা হলে থাকার সুযোগ পান না। তাদের থাকতে হয় ক্যাম্পাসের আশপাশের কটেজ, মেসে ও দূরের চট্টগ্রাম শহরে। ফলে ছাত্রীদের বেশির ভাগই ভোট দিতে আসবেন ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে।

প্রার্থীরা ছাত্রীদের উদ্দেশে দিয়েছেন আলাদা প্রতিশ্রুতি। নিরাপদ ক্যাম্পাস, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কার্যকর নীতি, পোশাক ও চলাফেরার স্বাধীনতা, নারী জিমনেসিয়াম, স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন-মন নানা প্রতিশ্রুতি ছিল প্রচারণার মূল বিষয়। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বামপন্থি জোট-সব প্যানেলই নারী ভোটারদের গুরুত্ব বুঝে ইশতেহারে বিশেষ দফা যুক্ত করেছে।

‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ ছাত্রীদের জন্য শাটল ট্রেনে আলাদা বগি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ‘দ্রোহ পর্ষদ’ বলেছে, নারীদের জন্য পৃথক শৌচাগার চালুর ব্যবস্থা করবে। যোগ্য ছাত্রীদের দেওয়া হবে এককালীন বৃত্তি। এ ছাড়া যৌন হয়রানির অভিযোগে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে তারা সেল গঠন করবে। অন্যদিকে ছাত্রদলের প্যানেল দিয়েছে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার। আর ছাত্রশিবিরের ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ বলছে, ক্যাম্পাসে আলাদা নারী জিম ও কমনরুম করবে তারা।

ছাত্রীদের প্রত্যাশা- নিরাপত্তা ও সম্মান : বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী বলেছেন, তাদের কাছে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তবায়নের সম্ভাবনা। ছাত্রীদের বেশির ভাগ ভোট যে প্যানেলে পড়বে, সে প্যানেলই জিতে যাবে। নৃবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘রাতের বেলা ক্যাম্পাসে চলাচল করতে তিনি নিরাপদ বোধ করছেন না। কিছুদিন আগেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। একজন ছাত্রীর রাত করে ফেরা নিয়ে ওই সংঘর্ষ হয়েছিল। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে এখনও উদ্বেগ রয়েছে। এবার আমরা এমন প্রার্থী বেছে নেব, যিনি আমাদের সমস্যাগুলো সত্যি বুঝবেন।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা নিরাপদ ক্যাম্পাস প্রত্যাশা করছি। আমরা চাই কোনো ছাত্রী যেন ক্যাম্পাসে নিপীড়নে শিকার না হন। অসম্মানিত না হোন। প্রার্থীদের যাঁরা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করবেন, এমন প্রার্থীকে ভোট দেব।’

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ১৩ প্যানেলের বেশির ভাগ ইশতেহারেই নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। প্রার্থীরা বলছেন, তারা চাপ দিয়ে প্রশাসনকে নিরাপত্তা জোরদার করতে বাধ্য করবেন। ছাত্রীদের চলাফেরা এখন আগের চেয়ে স্বস্তিদায়ক হলেও রাতে অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। অনুষদের সামনে, বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে টহল বাড়ানোর দাবিও রয়েছে তাদের।

চাকসু নির্বাচনের ইতিহাসে নারী ভোটারদের এমন প্রভাব আগে ছিল না। কারণ, তখন ছাত্রীসংখ্যা ছিল হাতে গোনা। নব্বইয়ের দশক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এর মধ্যে গড়ে ৪০ শতাংশই ছাত্রী। বর্তমানে ৪৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউটে পড়ছেন ১১ হাজার ৬০৪ জন ছাত্রী। ফলে প্রার্থীরা জানেন, ছাত্রীদের মন জয় করাই এবার আসল লড়াই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ রয়েছে। অনেকেই প্রথমবার ভোট দিচ্ছেন। তাদের কাছে চাকসু মানে একধরনের নতুন সম্ভাবনা, যেখানে ক্যাম্পাস রাজনীতি আধিপত্য থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক পথ তৈরি করবে। সমাজতত্ত্ব দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘চাকসু নিয়ে এখন ছেলেরা যেমন আগ্রহী, মেয়েরাও ঠিক তেমন। আমরা চাই আমাদের কথা বলার জায়গা হোক।’

নারী প্রার্থী ৪৭, শীর্ষ পদে মাত্র ১ : বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনি ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, অতীতে চাকসুর পদগুলোয় ছাত্রীর সংখ্যা ও ভোটার খুবই কম ছিল। সর্বশেষ নির্বাচনে (১৯৯০) মোট ভোটার ছিলেন ১০ হাজার ৫২৬। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ২ হাজার ২৭৬। এবার কেন্দ্রীয় সংসদে ৪৭ জন নারী প্রার্থী আছেন। ১৩টি প্যানেল নির্বাচনে লড়ছে। অথচ শীর্ষ পদে শুধু একজন প্রার্থী আছেন। প্যানেলগুলো শীর্ষ পদে নারী প্রার্থী না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলছে, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ ও সাংগঠনিক দুর্বলতা। তবে ছাত্রীরা মনে করছেন, মূল সমস্যা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি এবং সব সময় নারীকে পিছিয়ে রাখার প্রবণতা।

যে প্যানেল থেকে একমাত্র নারী প্রার্থী হয়েছেন, তা হলো ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশন জোট বেঁধে এ প্যানেল দিয়েছে। তাদের প্যানেল থেকে জিএস পদে নির্বাচন করছেন চৌধুরী তাসনীম জাহান শ্রাবণ। তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। তাসনীম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ফলে অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই তিনি পরিচিত। এবার প্রচারণা চালাতে গিয়ে তিনি দারুণ সাড়া পেয়েছেন।

অন্যদিকে চাকসুতে এজিএস (সহ-সাধারণ সম্পাদক) পদে নির্বাচন করছেন দুই ছাত্রী। তারা হলেন আইন বিভাগের ছাবেকুন নাহার (স্বতন্ত্র) ও ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের জান্নাতুল ফেরদৌস। জান্নাতুল নির্বাচন করছেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেল থেকে। জান্নাতুল প্রচারণায় বেশ সরব ছিলেন।