পুড়ল কার্গো ভিলেজ অচল বিমানবন্দর
* নিয়ন্ত্রণে ফায়ার ব্রিগেডের ৩৬ ইউনিট * ঢাকার ফ্লাইট অবতরণ করল চট্টগ্রাম-সিলেট-কলকাতায় * কুরিয়ার গুদাম থেকে আগুন লাগে * আগুন নেভাতে রোবটের ব্যবহার * ফ্লাইট বাতিল ও ভোগান্তিতে যাত্রীরা
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানির কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। কার্গো কমপ্লেক্সের আট নম্বর গেটের পাশে আগুন লাগে, পরে তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল শনিবার দুপুর থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৩৬টি ইউনিটের পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিট, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনী একযোগে কাজ করে। রাত ৯টা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে বিমান উড্ডয়ন বন্ধ রাখা হয়, এতে ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে আগুন লাগার পর মুহূর্তেই কালো ধোঁয়া উড়তে থাকে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। আগুন এতটাই ভয়াবহ যে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। কার্গো ভিলেজের বাইরে উৎসুক জনতার ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। মাইকিং করে উৎসুক জনতাকে সরে যেতে বলে বিমানবাহিনী। একইসঙ্গে ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়ন করা হয়। আগুনের ঘটনায় বিমানবন্দরে প্রবেশের পথগুলো বন্ধ রাখা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, বিমানবন্দরের আট নম্বর গেটের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। গতকাল শনিবার দুপুর ২টা ৩৪ মিনিটে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের প্রথমে নয়টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরে আরও ২৮টি ইউনিট যোগ হয়, মোট ৩৭টি ইউনিট একযোগে কাজ করে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কার্গো সেকশনে সংঘটিত অগ্নি নির্বাপণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিট এবং নৌবাহিনী কাজ করেছে।
ঢাকার ফ্লাইট চট্টগ্রাম, সিলেট ও কলকাতায় অবতরণ : বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিমান ওঠানামা সাময়িক বন্ধ করে দেয় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। পরে ঢাকার পরিবর্তে বেশকিছু ফ্লাইট চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। গতকাল বিকালে শাহ আমানত বিমানবন্দরের মুখপাত্র মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল জানান, যে আটটি ফ্লাইট চট্টগ্রামে অবতরণ করেছে, তার মধ্যে দুটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ছিল। অন্য ৬টি ফ্লাইটের একটি ব্যাংকক থেকে, আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঢাকায় অবতরণ করার কথা ছিল। বাকি চারটিও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। এ সব ফ্লাইট ঢাকার বদলে চট্টগ্রামে অবতরণ করে। আর দুটি ফ্লাইট সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। আগুন লাগার পরেই ঢাকাগামী কয়েকটি প্লেন বিকল্প রূটে পাঠানো হয়। কলকাতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, দিল্লি ও চেন্নাই থেকে ঢাকাগামী দুইটি প্লেন কলকাতায় অবতরণ করে। তবে সেই প্লেন কখন কলকাতা বিমানবন্দর ছেড়ে যাবে সেই বিষয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি। যতক্ষণ না ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে ততক্ষণ এই প্লেন দুটি কলকাতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকবে।
কুরিয়ার গুদাম থেকে আগুন লাগে : বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের যে অংশে কুরিয়ারের কাজকর্ম চলে, সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার কথা বলছেন কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা। অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলেন, গতকাল শনিবার সরকারি ছুটির দিনে দুপুর ২টা পর্যন্ত কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম চলে। সেখানে তখনও অনেক শ্রমিক ও আনসারসহ লোকজন ছিলেন। কিন্তু আগুন লাগার পর আনসারসহ অন্যরা সবাইকে সরিয়ে দেন। তখন বলা হয়, এই গুদামে গোলাবারুদসহ রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে; বিস্ফোরণ ঘটতে পারে; সবাই সরে যান।
শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম বন্ধ থাকলেও কুরিয়ার শাখায় আধাবেলা কাজকর্ম চলে। এ কারণে এক শিফটের কর্মীরা আগেই বের হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী শিফটে যাদের আসার কথা ছিল, তাদের অনেকে তখনও ঢোকেননি। আবার সারা দিনের শিফটে যাদের কাজ করার কথা ছিল, তাদের তখন দুপুরের খাবারের বিরতি চলছিল। এ কারণে আগুন লাগার সময় সেখানে এয়ারলাইন্স ও এজেন্টদের কর্মী কম ছিল। মিঠু বলেন, কুরিয়ার গুদামের একপাশে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। দেশের পোশাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্পের জন্য আনা অনেক রাসায়নিক আকাশপথে আমদানি করা হয়। তিনি দাবি করেন, ‘আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর ফটকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিলেন না।’
বিমানের কার্গো শাখার তিনজন কর্মী দাঁড়িয়েছিলেন। তারা বলছেন, কুরিয়ার শাখা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর তারা দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। আমদানির কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে উড়োজাহাজ পার্কিং করার ১০ থেকে ১৪ নম্বর বে। আগুন লাগার পর এখানে রাখা কয়েকটি উড়োজাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বিমানের কর্মীরা। কুরিয়ার সেকশনে থাকা বিমানের কর্মীরা বলছেন, কুরিয়ার সেকশনের সেডের বাইরেও অনেক মালামাল উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে রাখা হয়েছিল; সেগুলোও পুড়ে গেছে।
আগুন নেভাতে গিয়ে আনসারের ২৫ সদস্য আহত : বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুন নেভাতে গিয়ে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ২৫ সদস্য আহত হয়েছেন। গতকাল বিকালে আনসার ও ভিডিপির গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. আশিকুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে আনসার ও ভিডিপির এক হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়। এরমধ্যে ২৫ জন সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে আটজনকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে। বাকি সাতজনকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আগুনে নেভাতে রোবট : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি ‘রিমোট কন্ট্রোল ফায়ার ফাইটিং রোবট’ ব্যবহার করা হয়েছে। এই রিমোট কন্ট্রোল ফায়ার ফাইটিং রোবট মানুষের সাহায্য ছাড়াই খুব কাছ থেকে আগুনে পানি নিক্ষেপ করতে সক্ষম। এছাড়া যেখানে আগুনের শিখা রয়েছে সেখানে মুখে করে পানি দিতেও পারে এই রোবট। গতকাল বিকালে রিমোট কন্ট্রোল ফায়ার ফাইটিং রোবট বিমানবন্দরে আনা হয় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম।
ফ্লাইট বাতিল ও বিলম্বে ভোগান্তিতে যাত্রীরা : কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের কারণে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এয়ারফিল্ড রাত ৯টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। সর্বশেষ ৮টি ফ্লাইটের পর নতুন কোনো ফ্লাইট ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ডাইভার্ট হয়ে আসেনি। এদিকে ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্ব হওয়ার কারণে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। এক যাত্রী বলেন, আমার সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা, আজ রাত ১০টা ২৫ মিনিটে ফ্লাইট ছিল। আসার সময়ই শুনেছি যে বিমনাবন্দরে আগুন লেগেছে। অথচ ফ্লাইট ডিলে হবে কি হবে না বা ফ্লাইট কখন ছাড়বে সেটা নিয়ে কোনো তথ্য এখানে বোর্ডে বা ডিজিটাল স্ক্রিনে দেখাচ্ছে না। দেখালে সুবিধা হতো। এটা নিয়ে বিড়ম্বনায় আছি। তিনি আরও বলেন, আমি এসেছি কুমিল্লা থেকে। সিঙ্গাপুরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যে ফ্লাইটটি যাওয়ার কথা সেটি এখনও আসেনি। এখানে কর্তৃপক্ষের এমন কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না যিনি আমাদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন। কেউ আমাদের কোনো তথ্য দিতে পারলে এতটা হেজিটেশনে থাকতাম না। ৫ ঘণ্টায়ও বিমানবন্দরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এই ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক উল্লেখভ করে এই যাত্রী আরও বলেন, এখানে উন্নতমানের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল, যেটা নিয়ে সরকারের চিন্তা করার কথা। অথচ আমাদের মতো সাধারণ জনগণ এটা নিয়ে চিন্তা করছে। এরকম একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোনো ডিসিপ্লিন নেই। বিমানবন্দরে আসা আরও এক যাত্রীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তার ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে। তিনি জানান, তার সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল, ফ্লাইট ছিল সাড়ে ৭টায়। কিন্তু তা ক্যান্সেল হয়ে গেছে।
বারবার অগ্নিকাণ্ড স্পষ্ট করেছে নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাণ্ড তারেক রহমান : হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বারবার আগুন লাগার ঘটনা জননিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা ও শৃঙ্খলা জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট করে দিচ্ছে বলে মন্তব করেন তিনি। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে এক ফেসবুকে পোস্টে তারেক রহমান এই মন্তব করেন। পাশাপাশি আগুনের ঘটনায় তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানান।
ফেসবুকে ইংরেজিতে লেখা পোস্টে তারেক রহমান লেখেন, ‘হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত ও আক্রান্ত সবার প্রতি রইল আমার সহমর্মিতা ও প্রার্থনা। আশা করি সবাই নিরাপদে আছেন।’ আগুনের ঘটনায় দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাদের পেশাদারত্ব ও জনসেবার প্রতি নিষ্ঠা সত্যিই প্রশংসনীয়। বারবার আগুনের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তে জোর দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লেখেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা- বিশেষ করে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের কারখানা ও মিরপুরের পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা জননিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা ও শৃঙ্খলা জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট করে দিচ্ছে।’
