জোবায়েদ হত্যাকাণ্ড প্রেম ঘটিত, সন্দেহ পুলিশের
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জবি প্রতিনিধি

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জোবায়েদ হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার এ তথ্য জানান লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামি। হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ বলছে, ওই ছাত্রীর প্রেমঘটিত কারণেই খুন হয়েছেন জুবায়েদ। বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা জানিয়েছেন, বর্ষা ও তার বন্ধু মাহির রহমানের প্রেমের জেরে খুন হয়েছেন জবি শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জুবায়েদ হোসাইন। গত রোববার রাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার একটি ভবনের সিঁড়ি থেকে জোবায়েদের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার গলায় ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। জোবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
জুবায়েদ হত্যা অভিযুক্ত মাহিরকে থানায় দিলেন মা : জোবায়েদ হোসেন হত্যার ঘটনায় মাহিরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রোববার রাতে পুলিশের কয়েক স্থানে অভিযানের পর সোমবার ভোরে মাহিরের মা তাকে বংশাল থানায় নিয়ে সোপর্দ করে। মাহিরের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে, পুরান ঢাকায় টিউশনিতে যাওয়ার পথে খুন হন জোবায়েদ হোসেন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ বলছে, ওই ছাত্রীর প্রেমঘটিত কারণেই খুন হয়েছেন জোবায়েদ। পুলিশ জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা জানিয়েছেন, বর্ষা ও তার বয়ফ্রেন্ড মাহির রহমানের প্রেমের জেরে খুন হয়েছে জবি শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসাইন। সোমবার সকালে বংশাল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিকুল ইসলাম বর্ষাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এসব তথ্য জানান। রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্ষার সঙ্গে মাহির রহমানের ৯ বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মাহির রহমান বোরহানুদ্দীন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আর বর্ষা পড়ত ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে। পাশাপাশি বাড়িতে তাদের বেড়ে ওঠা ছোট থেকে। তাদের মধ্যে ছিল দীর্ঘ প্রেমের সম্পর্ক। চতুর্থ শ্রেণি থেকে একে অপরকে পছন্দ করত। কিন্তু সম্প্রতি তাদের সম্পর্কে টানাপড়েন ঘটে। কিছুদিন আগে তাদের সম্পর্কের ভাঙন হয় এবং বর্ষা তার বয়ফ্রেন্ড মাহির রহমানকে জানায়, সে জোবায়েদকে পছন্দ করে। এটা জানার পর রাগে ক্ষোভে মাহির রহমান তার বন্ধুকে নিয়ে জোবায়েদকে হত্যা করেছে।
ওসি বলেন, সম্প্রতি বর্ষা মাহিরকে জানায়; সে জোবায়েদকে পছন্দ করে। কিন্তু জোবায়েদকে সে তার পছন্দের কথা এখনো জানায়নি। জোবায়েদের সঙ্গে বর্ষার কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই। তাদের মধ্যে এ ধরনের কোনো মেসেজও পাওয়া যায়নি। কিন্তু বর্ষার কথার ওপর ভিত্তি করে রাগে ক্ষোভে বর্ষার বয়ফ্রেন্ড তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে জোবায়েদকে খুন করে। এ সময় ওসিকে জোবায়েদের বন্ধুর সঙ্গে ছাত্রী বর্ষার পরিচয় কীভাবে এটা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, বর্ষার সঙ্গে জোবায়েদের বন্ধু সৈকতের পরিচয় হয় ফেসবুকে। এ ছাড়া অন্যকোনো মাধ্যমে তাদের কথা হতো না বা অন্যকোনো সম্পর্কও ছিল না। যেহেতু সৈকত জোবায়েদের বন্ধু ছিল এ জন্য জোবায়েদের মৃত্যুর খবর দিয়ে সৈকতকে মেসেজ করে বর্ষা। ওসি বলেন, বর্ষার মধ্যে কোনো হতাশা বা কান্নার কোনো ছাপ পাওয়া যায়নি। তার মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে কোনো নার্ভাসনেসও পাওয়া যায়নি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ষাকে চিন্তামুক্ত দেখা গেছে। আমরা আরও বিস্তর তদন্ত করব। পরে আরও বিস্তারিত জানানো হবে আনুষ্ঠানিকভাবে।
সহপাঠী-শিক্ষকদের অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জবি শিক্ষার্থী জুবায়েদের : জোবায়েদ হোসাইনের প্রথম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। এ সময় শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়। পরে মরদেহ নিজ জেলা কুমিল্লার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়; সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. শেখ গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমার বিভাগের পক্ষ থেকে তার জন্য মাগফিরাত কামনা করছি। তার শোকাহত পরিবারের প্রতি দোয়া ও ধৈর্য ধারণের জন্য প্রার্থনা করছি। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, জোবায়েদ সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে শহিদ হয়েছেন। আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি। এই মাসেই আমাদের আরেকজন সহযোদ্ধা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এটাকে আমরা নিছক একটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখছি না। আমরা এই হত্যাকাণ্ডগুলো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তবুও আমাদের দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তার করতে হবে। আমরা এসব হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক রঙ দেব না। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলব, আপনারা দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করুন। নাসির উদ্দিন আরও বলেন, আমি খুবই মর্মাহত। আমরা তার বিদায়ী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। এছাড়া শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, আইন অনুযায়ী দ্রুত বিচার করতে হবে। আমরা আল্লাহর কাছে তার মাগফিরাত কামনা করি। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন বলেন, আমার শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসাইন আমাদের পাশেই শুয়ে আছে। তার এই পরিণতি আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি। তাকে সামনে রেখে জানাজার নামাজের পূর্বে কথা বলব এটা ভাবতেও পারিনি। সমাবর্তনে তার মাথায় আমার ক্যাপ তুলে দেওয়ার কথা ছিল। তার বাবা-মা তাকে ডিগ্রি অর্জনের জন্য পাঠিয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, জোবায়েদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছি- দ্রুত সময়ে হত্যা মৃত্যুর দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জোবায়েদ একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল; মাঝে মাঝে আমার কাছে আসত। খুবই ভালো ছেলে ছিল সে। এমন একটি ছেলের শত্রু থাকতে পারে- এটা আমাদের কল্পনায় ছিল না। আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করুন।
আমি আমার ছেলের মাকে কী করে যে বোঝাবো- জুবায়েদের বাবা : জুবায়েদ হোসেনের জানাজা পূর্ব সমাবেশে ভাঙা স্বরে জোবায়েদের বাবা মোবারক হোসেন বলেন, আমার ছেলের মৃত্যুর পর আমি দেখেছি সকল শিক্ষার্থী আন্দোলন করেছে। আমার এই ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম অনেক বড় হবে। আমার ছেলে লাশ হয়ে গেল- আমি বাবা বেঁচে আছি। আমার ছেলেকে আমি ‘যুব’ বলে ডাকতাম। আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই। জুবায়েদের বাবা আরও বলেন, আমি জুবায়েদের মা’কে কী করে যে বোঝাবো, তার প্রাণের ছেলে আর দুনিয়াতে নেই। আমার ছেলে বড় হয়েছিল। আমি ঢাকায় ব্যবসার মাল (পণ্য) কিনতে আসলে, সে আমার সঙ্গে থাকতো। আমি তার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতাম।
মোবারক হোসেন বলেন, আমার ৫৮ বছরের জীবন-যৌবনের সব অর্জন শেষ। আমার প্রাণের জুবায়েদ আর নেই। আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই। আর সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন।
