
ডেঙ্গুতে চলতি বছর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল গত সেপ্টেম্বর মাসে। তবে চলতি অক্টোবর মাস শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই গত মাসের চেয়ে বেশি সংখ্যায় ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জনস্বাস্থ্যবিদদের আশঙ্কা, আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসেও দেশের ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে না, বরং বাড়তে পারে। এর অর্থ হলো, এ বছরের সংক্রমণ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে এবং নতুন বছরের সঙ্গে যুক্ত হবে। এতে আগামী বছরেও এ রোগের প্রাদুর্ভাবমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আর থাকছে না।
সূত্রমতে, অক্টোবর পেরিয়ে গেলেই যেখানে ডেঙ্গু থেকে একটু স্বস্তির সম্ভাবনা মেলে, এ বছর তাও গুঁড়েবালি। ক্যালেন্ডারের হিসাবে ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হলেও বাস্তবতা বলছে, দিন দিন বাড়ছে এর ভয়াবহতা। যার বিস্তার ছড়িয়েছে দেশের ৬৩টি জেলায়। এখনও হাসপাতালে যে হারে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন তাতে চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধারাবাহিকতা চলতে পারে এবারের শীত মৌসুমেও। ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, এখন আর মৌসুম নেই এডিস মসার, সচেতন থাকতে হবে সারা বছর।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন করে আরও ৬৫৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তবে এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন করে কারো মৃত্যু হয়নি। গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১২৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০৪ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ১৭০ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১২৪ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৫৭ জন, খুলনা বিভাগে ৩১ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৭ জন রোগী রয়েছে। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছে ৬১ হাজার ৩৯৩ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৬৪ হাজার ২৯৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৯৯ জন। সেপ্টেম্বর মাসে দেশে চলতি বছরের সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়। এর সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৮৬৬। আর চলতি মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১৬ হাজার ২৯৬। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নতুন আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৬১ শতাংশই পুরুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সি মানুষ।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১৫৮ জন। এ সময় দুই সিটির বাইরে ঢাকা বিভাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীরর সংখ্যা ছিল ১০৪। ঢাকা বিভাগের বাইরে বরিশাল বিভাগে রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল, এ সংখ্যা ৭৩। চলতি মাসের শুরু থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। সপ্তাহখানেক ধরে বৃষ্টি কমেছে। এতে মশার বংশবৃদ্ধির গতি কমে আসতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এরইমধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দিয়েছে, এ মাসের শেষে সাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হতে পারে। এরইমধ্যে একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই লঘুচাপ থেকে যদি নিম্নচাপ হয়, তবে চলতি সপ্তাহের শেষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হতে পারে। এতে ডেঙ্গুর জীবাণু এডিসের বিস্তার আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজীর আহমদ। তিনি বলেন, ‘এবারের বৃষ্টির ফলে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজননের ধারবাহিকতা অটুট থাকবে। ডেঙ্গু কমেনি, মশাও কমেনি। এরমধ্যে যদি আবার বৃষ্টি হয়, তার অর্থ হলো নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসেও ডেঙ্গু কমবে না। আর এর মাধ্যমে আমরা ডেঙ্গু নিয়ে নতুন বছরে প্রবেশ করব। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো কার্যকারিতা দেখাচ্ছে না। এটারই ফল ডেঙ্গুর এবারের বড় ধরনের সংক্রমণ।’ চলতি বছরের শুরুতে ডেঙ্গু বেড়ে গেলেও মার্চ মাস থেকে তা কমতে থাকে। তবে জুন মাস থেকে প্রকোপ বাড়তে থাকে। তখনই জনস্বাস্থ্যবিদেরা আশঙ্কা করেছিলেন, এবার ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়তে পারে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তা আগের বছরের এই সময়ের চেয়ে বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় সরকার-কেউই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি। তারা নতুন কিছু তো করেইনি, উপরন্তু বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গড়ে ওঠা ব্যবস্থাও নষ্ট করে ফেলেছে। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ঈশিতা বিশ্বাস বলেছেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য যে পরিমাণ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, তা তুলনায় অপ্রতুল। তাই যে কোনো সময় ডেঙ্গু প্রকোপ থাকতে পারে।’ ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের ভয় হলো আগামী দু-এক মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বেশি থাকবে। ডেঙ্গু এখন মৌসুমি নাই, বছরব্যাপী এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। যদি আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি, তাহলে শীতকালেও ডেঙ্গু প্রকোপ বাড়তে পারে।’ একই শঙ্কার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরাও। তারা জানান, ডেঙ্গু প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে বছরব্যাপী। কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘কিউডেঙ্গা হচ্ছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো ভ্যাকসিন। এটা বাংলাদেশে প্রয়োগ করা যায় কি না, সবাইকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের যে প্রক্রিয়া চলছে সেটি আরও জোরদারের পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের।