ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

‘শাপলা কলি’ প্রতীকের গেজেট প্রকাশ

‘শাপলা কলি’ প্রতীকের গেজেট প্রকাশ

শাপলা প্রতীকের দাবিতে অনড় অবস্থান জানিয়ে আসছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে ইসির প্রতীক তালিকায় না থাকায় এই প্রতীক দেওয়া যাবে না বলে এত দিন বলে আসছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল বৃহস্পতিবার ইসির নতুন যে প্রতীক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার আহমেদ স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য প্রতীকের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে শাপলা কলিসহ বেশ কিছু প্রতীক সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর ১১৫টি প্রতীক সংরক্ষণ করে সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন। সেখানে শাপলা কলি ছিল না।

গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছাত্র-তরুণদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কয়েক মাস আগে ইসির পর্যালোচনায় নিবন্ধনযোগ্য দল বিবেচিত হয়। এর পর থেকে এনসিপিকে শাপলা প্রতীক বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছিলেন দলটির নেতারা।

এ বিষয়ে অপরাগতা জানিয়ে আসছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীনসহ নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। সর্বশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এনসিপি শাপলা প্রতীক পাচ্ছে না, কারণ হচ্ছে যে আমাদের ১১৫টার যে শিডিউলটা করা হয়েছে, সেখানে শাপলা প্রতীক নেই।’

তবে গত সোমবার এনসিপিকে শাপলা প্রতীক না দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই মন্তব্য করে দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছিলেন, ‘যেহেতু আইনগত বাধা নেই, আমরা আমাদের জায়গা থেকে শাপলা আদায় করে নেব।’ গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ইসির নতুন প্রতীকের তালিকায় ‘শাপলা কলি’ প্রতীক যুক্ত করা হলো।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে নির্বাচন ভবনে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, শাপলা আর শাপলা কলি প্রতীকের মধ্যে পার্থক্য আছে। নানা সমালোচনার মুখে প্রতীকের তালিকা সংশোধন করে শাপলা কলি প্রতীকটি বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রয়োজন মনে করলে আবারও সংশোধন করা হবে।

শাপলা প্রতীকটি বিধিমালায় না থাকায় কোনো দলকে দেওয়া যাবে না- তাহলে কোনো বিবেচনায় শাপলা কলি প্রতীকটি বিধিমালায় যোগ করা হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের প্রতীকের তালিকা নিয়ে অনেক সমালোচনা ছিল। তাই আগের তালিকা থেকে ১৬টি প্রতীক বাদ দিয়ে ১১৯টি প্রতীক সংরক্ষণ করা হয়েছে।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইসি মনে করেছে শাপলা কলি রাখা যেতে পারে। এটা কারো দাবির প্রেক্ষিতে করার বিষয় নয়। আপনারা জানেন, একটি দল শাপলা চেয়েছে। এখন শাপলা প্রতীক আর শাপলা কলির মধ্যে পার্থক্য আছে। কমিশন মনে করেছে এটা করা যায়, তাই করা হয়েছে। যেহেতু কিছু বিরূপ মন্তব্য এসেছে, তাই কিছু বাদ দিয়ে কিছু যোগ করা হয়েছে।

আখতার আহমেদ আরও বলেন, কে চেয়েছে বা কে চায়নি সেটা বিষয় নয়; শাপলা কলি প্রতীকটি যোগ করার সিদ্ধান্ত কমিশনের। ভবিষ্যতে যদি কমিশন প্রয়োজন মনে করে, তাহলে আবারও পরিবর্তন করতে পারবে।

সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) নিবন্ধন দেওয়ার লক্ষ্যে ৫০টি প্রতীক থেকে নিজেদের প্রতীক বাছাই করে জানাতে বলা হয়েছিল ইসির পক্ষ থেকে, যেখানে বেগুন, বালতির মতো প্রতীকগুলো রাখা হয়েছিল। এনসিপি ইসির সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শাপলা প্রতীকটি বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানায়। একই সঙ্গে তারা ঘোষণা করে, শাপলা এবং শাপলাই হবে তাদের মার্কা এবং শাপলা প্রতীক ছাড়া দলটি নিবন্ধন নেবে না।

ইসি নতুন প্রতীকের তালিকায় যুক্ত হয়েছে ‘শাপলা কলি’। প্রতীকটি যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে । তবে ইসির এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

গতকাল বৃহস্পতিবার ‘শাপলা কলি’ প্রতীকের তালিকায় যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের এমন মন্তব্য করেছেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব জহুরুল ইসলাম মুসা।

তিনি বলেন, ‘আমাদের ‘শাপলা কলি’ দেওয়া হলে তা আমরা মানি না। আমরা শাপলাই চাই। ‘শাপলা কলি’ প্রতীকের তালিকায় যুক্ত করায় আমরা সন্তুষ্ট নই।’

জানা যায়, এর আগে কয়েকদফা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে শাপলা প্রতীক পেতে বৈঠক করেছে জাতীয় পার্টি (এনসিপি)। এছাড়া দলটির পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছিল শাপলা না দিলে তারা নিবন্ধন নেবে না। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করা হলো প্রতীকের তালিকায়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন উত্তপ্ত ও প্রাণচঞ্চল। অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে- সব প্রস্তুতি শেষ, এখন শুধু জনগণের অংশগ্রহণের অপেক্ষা।

প্রস্তুতি শতভাগ, এখন নজর ভোটারের আস্থায় : রাজধানী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নির্বাচনি যন্ত্র সচল রাখতে যে বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো প্রয়োজন, তা এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। ইসির ভাষায়, ‘ভোটের সব আয়োজন সম্পন্ন, এখন সময় ভোটারদের আস্থা পরীক্ষার।’

ইসি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রাথমিক সময়সূচি নির্ধারিত। এরইমধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, আসন সীমানা পুনর্বিন্যাস, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও আইনগত সংশোধনসহ প্রায় সব প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমরা একটি উৎসবমুখর, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। এজন্য প্রশাসনিক, প্রযুক্তিগত বা আইনগত কোনো ঘাটতি যেন না থাকে, সেটিই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য।’ তার ভাষ্য অনুযায়ী, ভোটার তালিকা ও কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার শতভাগ হালনাগাদ করা হয়েছে। এ বছর নতুন ভোটার হয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ, যার মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী।

ইসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে এখন মোট ভোটার ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫০৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪১ লাখ, নারী ৬ কোটি ২২ লাখ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩০ জন। সারাদেশে ভোটের জন্য ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি ভোটকক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছে।

৯৫ শতাংশ কাজ শেষ, বাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতা : ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ শেষ। রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত হলেই আমরা শতভাগ প্রস্তুত।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইসির বিভিন্ন দায়িত্বে ১৮টি টাস্কফোর্স কাজ করছে- কেউ লজিস্টিক, কেউ আইটি, কেউ নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান করছে।’

আইন, প্রযুক্তি ও আচরণবিধিতে বড় পরিবর্তন: গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও আচরণবিধির সংশোধনে এসেছে বেশ কিছু নতুন দিক। পুনর্বহাল হয়েছে ‘না ভোট’। ইভিএম ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা বাতিল। প্রার্থীর সম্পদ, আয় ও করের তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক। অনুদান গ্রহণে ব্যাংকিং চ্যানেল বাধ্যতামূলক। পলাতক আসামিদের প্রার্থিতা নিষিদ্ধ। নির্বাচনি জামানত ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা। ইসি বলছে, এসব সংস্কার নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।

নিরাপত্তায় কঠোর নজরদারি: নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গঠিত হয়েছে একাধিক সমন্বয় কমিটি। ভোটের আগে তিন দিন, ভোটের দিন এবং ভোটের পর চার দিনসহ মোট আট দিন মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে দেড় লাখ পুলিশ, এক লাখ সেনাসদস্য এবং আনসার-ভিডিপির সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্য। প্রথমবারের মতো তাদের জন্য বিশেষ আচরণবিধি ও প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করা হয়েছে, যাতে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।

ডিজিটাল নিরাপত্তায় নতুন সেল : ভোটকালীন অনলাইন গুজব ও বিভ্রান্তি মোকাবিলায় ইসি গঠন করেছে ‘মিসইনফরমেশন মনিটরিং সেল’। এই সেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্ভর ভুয়া প্রচারণা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য শনাক্ত করবে। এর কাজ পরিচালিত হবে এনটিএমসি, বিটিআরসি, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আইসিটি বিভাগের সহযোগিতায়।

প্রবাসী ভোটারদের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর ভোটিং : প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করছে ইসি। এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত ভোটাররা ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ১১টি দেশে এই উদ্যোগ শুরু হয়েছে, আগামী বছর আরও আট দেশে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে নির্বাচনের গুরুত্ব : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহিতুল হক বলেন, ‘নির্বাচনের আগে ইসির স্বচ্ছতা ও দৃঢ় মনোভাবই জনগণের আস্থা ফেরানোর প্রথম ধাপ। কমিশন যদি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, তাহলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব।’

ভোটে প্রযুক্তিগত নতুনত্ব ও মনিটরিং ব্যবস্থা : সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে ইসি তাদের সার্ভার ও ভোটার ডেটাবেজ আপগ্রেড করেছে। এবার প্রতিটি জেলার কন্ট্রোল রুম থেকে রিয়েল-টাইমে ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করা হবে। ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আমরা এবার প্রক্রিয়াগত ব্যর্থতা শূন্যে নামাতে চাই। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের হিসাব ডিজিটালি রিপোর্ট হবে কমিশনে।’

ভোটার সচেতনতা ও অংশগ্রহণে জোর : ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এরইমধ্যে গ্রামীণ পর্যায়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রচারণা। রেডিও, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউনিয়ন পরিষদে চলছে সচেতনতা কার্যক্রম। ইসি তথ্য ও প্রচার বিভাগ জানিয়েছে, এবার নারী ও তরুণ ভোটারদের বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছে। একজন কমিশন কর্মকর্তা বলেন, ‘১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণরা যদি ভোটে আসে, নির্বাচনে প্রাণ ফিরে আসবে।’

রাজনৈতিক অঙ্গন, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের দৃষ্টি এখন এক জায়গায়- কেমন হয় আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। ইসি বলছে, তাদের প্রস্তুতি শতভাগ সম্পন্ন, এখন সিদ্ধান্ত জনগণের হাতে। নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের ভাষায়, ‘এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আরেকটি মাইলফলক হবে। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণই এবার প্রকৃত বিজয়ী হবে।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত