বাড়ছে বিরোধ, বাড়ছে শঙ্কা

‘নির্বাচনের আগে গণভোটের সুযোগ এখন আর নেই’

ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে গভীর ফাটল : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সঙ্গে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটালেও এখন ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ নিয়ে গণভোট ইস্যুতে দুই দলের মধ্যে চরম বৈরিতা তৈরি হয়েছে। গণভোট জাতীয় নির্বাচনে ভোটগ্রহণের একই দিনে নাকি আগে- এ নিয়ে কথার লড়াইয়ে দল দুটির মধ্যকার রাজনৈতিক দূরত্ব দিনদিন বাড়ছে বৈ কমছে না। বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের কোনো সুযোগ নেই। জামায়াতের দিকে আঙুল তুলে দলটির মহাসচিব বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন বানচাল করার জন্য একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, বিএনপির এই অবস্থান তাদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় এবং নতুন করে রাজনৈতিক সংকট তৈরির অপপ্রয়াস। দলটির দাবি, নভেম্বরে গণভোট দিয়েই ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এই বিপরীতমুখী অবস্থানে সরকার কী সিদ্ধান্ত দেয়, এর দিকে এখন সারাদেশের দৃষ্টি

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনের আগে গণভোটের সুযোগ এখন আর নেই। নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে। দুটি ব্যালট থাকবে, একটি গণভোটের জন্য, আরেকটি জাতীয় সংসদের জন্য। এ বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়।

গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

নির্বাচন ও গণভোট প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা নির্বাচন করবো, নির্বাচন করতে চাই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার সঙ্গে আমরা একমত। কিন্তু আজ সেই নির্বাচন বানচালের জন্য একটি মহল উঠে-পড়ে লেগেছে, তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যারা এ নিয়ে রাস্তায় নেমে গোলমাল করছেন, তাদের অনুরোধ করবো, জনগণকে আর বিভ্রান্ত করবেন না। এক সময় আপনারা পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। আজ জনগণ যে নির্বাচন চায়, তার বিরোধিতা করবেন না। এই দেশের মানুষ দেশ বিক্রির রাজনীতিকে ক্ষমা করে না।’

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আপনারা যে কমিশন তৈরি করেছেন, সেই কমিশন ঐকমত্যের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। সংস্কার ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা অনেক ক্ষেত্রে একমত হয়েছিলাম। কয়েকটি বিষয়ে মতভেদ থাকায় আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেই। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও মূল বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম, এটাই নিয়ম। যখন আমরা নির্বাচনে যাবো, তখন ম্যানিফেস্টোতে এই বিষয়গুলো থাকবে। জনগণ যদি আমাদের ভোট দেয়, তাহলে আমরা সেসব বিষয় সামনে আনবো, পার্লামেন্টে পাস করে দেশের পরিবর্তন ঘটাবো। আর যদি ভোট না দেয়, তাহলে সেটি বাদ পড়বে।’

অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘যেদিন ঐকমত্যের নথি জমা দেওয়া হলো, (১৭ অক্টোবর) সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। তার আগে আবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমরা ঠিকঠাক করে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়ে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা ধরে সেখানে সই করলাম। কিন্তু যখন প্রধান উপদেষ্টার কাছে সেটা উপস্থাপন করা হলো, তখন দেখা গেলো অনেক পার্থক্য। বিশেষ করে আমরা যে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলাম, সেগুলো উল্লেখ করা হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের সঙ্গে তারা প্রতারণা করেছে। আমরা যে বিশ্বাসযোগ্যতা আশা করেছিলাম, তারা তা রাখেনি। তাই বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের দায় অন্তর্বর্তী সরকারের।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যারা বলে বিএনপি সংস্কার চায় না, তারা জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। বিএনপি সব সময় সংস্কারের পক্ষে। আগে ১০ দফা, পরে ২৭ দফা, এরপর ৩১ দফা দিয়েছে– সবই সংস্কারের জন্য। আমরা প্রত্যেকটি সভায় উপস্থিত থেকেছি, আলোচনা করেছি, শেষ পর্যন্ত ঐক্যমতের সনদে সই করেছি। বিভ্রান্তি যদি আসে, সেটা ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করতে চাই। যাদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে লড়েছি, একসঙ্গে কাজ করেছি, তাদের নিয়েই আমরা জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট– আসুন, সবাই মিলে নির্বাচনের সুযোগকে কাজে লাগাই। সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করে জনগণের পার্লামেন্ট, জনগণের সরকার গঠন করি।’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘দেশের বর্তমান সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধারের সক্ষমতা ড. ইউনূসের নেই। বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ নির্বাচন।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত। তারা কেন নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই সরকার সংবিধান সংশোধনের কোনও এখতিয়ার রাখে না। বিদ্যমান সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তারা নিজেদেরই বিপদে ফেলছে। সরকার দেশকে নতুন সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সংঘাত থেকে বের হওয়ার কোনও রাস্তা দেখানো হয়নি।’

সাইফুল হক আরও বলেন, ‘গণভোটের ঝুঁকি নেওয়ার মতো অবস্থানে দেশ নেই। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন বিভেদ সৃষ্টি হবে। ঐকমত্য কমিশন শেখ হাসিনার মতো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়লে অন্তর্বর্তী সরকারও ঝুঁকিতে পড়বে, দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে যেতে পারে।’

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘দেশের ইতিহাসের দুর্ভাগ্য– স্বৈরাচারকে সরিয়ে আবার নিজেদের মধ্য থেকেই স্বৈরাচার জন্ম নেয়। গণতন্ত্রের কথা বলি, অথচ বারবার কেন স্বৈরাচারের রাজনীতি ফিরে আসে? বিএনপির দুর্বলতার কারণেই নির্বাচন নিয়ে আজ জটিলতা দেখা দিয়েছে।’

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন চাইলে তিন মাস আগেই গণভোটের আলোচনা শেষ করতে পারতো। জুলাই মাসেই সনদ ও ঘোষণাপত্র হয়ে গেছে– এখন আর নির্বাচন নিয়ে বাধা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক পর্দার আড়ালে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য অনেকেই প্রকাশ্যে ঝামেলা করছে।’ জেএসডির সিনিয়র সহ-সভাপতি তানিয়া রবের সভাপতিত্বে এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন গণ-ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ।