নির্বাচন হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী দেশের জনগণের মতো সেনাবাহিনীও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। নির্বাচন হলে দেশের স্থিতিশীলতা আরও ভালো হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরও স্বাভাবিক হবে বলে মনে করে সেনাসদর। গতকাল বুধবার সেনাসদরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জেনারেল অফিসার কমান্ডিং, আর্মি সদর দপ্তরের ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ড (জিওসি আর্টডক) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সরকার নির্বাচনি রূপরেখার সময়সীমা দিয়েছে। আমরা আশা করি নির্বাচন হলে দেশের স্থিতিশীলতা আরও ভালো হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরও স্বাভাবিক হবে এবং সেনাবাহিনী তখন সেনানিবাসে ফিরে যেতে পারবে। আমরা সেদিকে তাকিয়ে আছি।

মাইনুর রহমান বলেন, সরকার এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যেটুকু রূপরেখা প্রণয়ন করেছে সেটার ওপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনী যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছে। আমাদের যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এখন সীমিত আকারে চলছে তারমধ্য নির্বাচনের সময় আমাদের কী করণীয় সেটাকে ফোকাসে রেখেই প্রশিক্ষণ করছি। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হল- যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। আমরা বলে থাকি ‘উই ট্রেইন এজ উই ফাইট’। গত ১৫ মাস সেনাবাহিনী বাইরে আছে উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর এ কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন পর্যন্ত বা তার কিছুটা পরেও যদি বাইরে থাকতে হয় তাহলে আরও কিছুদিন বাইরে থাকতে হবে। এতে করে আমাদের প্রশিক্ষণ বিঘ্নিত হচ্ছে।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমান বলেন, এর পাশাপাশি যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গত ১৫ মাস যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে সেনাবাহিনী; এটা সহজ পরিস্থিতি ছিল না। এ ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশ প্রতিদিন ফেস করেনি। এজন্য আমরাও চাই একটা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এবং আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসতে পারি গত ১৫ মাস সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসনের সহয়তায় নিয়োজিত আছে এবং অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। এ ১৫ মাস সেনাবাহিনী অত্যন্ত পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে বলেও উল্লেখ করেন সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা।

৫০ শতাংশ সদস্য প্রত্যাহারের সরকারি নির্দেশনা পেয়েছে সেনাবাহিনী : সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের (এমওডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন বলেছেন, মাঠপর্যায় থেকে ৫০ শতাংশ সেনাসদস্য প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার কথা জানিয়েছে সেনাবাহিনী। তবে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সারাদেশে মোতায়েন থাকা সেনাবাহিনীর অর্ধেক সদস্যকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর বলেন, ‘প্রত্যাহারের বিষয়ে আমরা চিঠি পেয়েছি... এবং সে অনুযায়ী, আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব’। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, বিশ্রাম ও নির্বাচনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের জন্য বুধবার থেকে এই সেনা সদস্যদের প্রত্যাহার করা হবে। প্রশিক্ষণ ও বিশ্রামের পর তারা ধাপে ধাপে পুনরায় মোতায়েন হবেন এবং বাকি সদস্যদের প্রতিস্থাপন করবেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর বলেন, গত ১৫ মাস ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করে আসছে। এর পাশাপাশি, চুরি যায়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার এবং চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৮১ শতাংশ খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও ৭৩ শতাংশ গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। কিশোর গ্যাং, ডাকাত ও চাঁদাবাজসহ ১৯ হাজারের বেশি সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছি।

সাম্প্রতিক অভিযানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করি। গত দুই সপ্তাহে আমাদের বোম্ব ডিসপোজাল টিম শতাধিক হাতে তৈরি বোমা নিষ্ক্রিয় করেছে। তিনি আরও বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবাহিনী আহতদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে। বিভিন্ন সিএমএইচে ৫,৩৮৮ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ২৭ জন এখনও ঢাকা সিএমএইচে চিকিৎসাধীন আছেন। এমওডি পরিচালক বলেন, সেনাবাহিনী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং দেশে কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও কাজ করছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশনায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা দেবে।

অভিযুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতি নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি বলে জানিয়েছে সেনাসদর। গতকাল বুধবার সেনা সদরের এজি শাখার পার্সোনেল সার্ভিসেস অধিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের মামলায় গত ২২ অক্টোবর ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা এখনও চাকরিতে বহাল আছেন কি না- ব্রিফিংয়ে এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর বলেন, ‘বিষয়টি আইনি ও প্রক্রিয়াগত কাঠামোর মধ্যে পড়ে। ৬ অক্টোবর প্রকাশিত আইসিটি আইনের তৃতীয় সংশোধনীতে সরকারি চাকরিতে অযোগ্যতা সংক্রান্ত বিষয়টি এসেছে।’

‘এখানে কোনো আইনি জটিলতা নেই। কিন্তু ব্যাখ্যার বিষয় আছে, কারণ সংশোধনীটি নানা দিক থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব,’ বলেন তিনি। ব্রিফিংয়ে এই সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং স্পষ্ট নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। যদি ডিসকোয়ালিফিকেশন বা অযোগ্যতা মানে চাকরিচ্যুতি হয়, তাহলে সেই চাকরিচ্যুতি কার্যকর করার প্রক্রিয়াটা সংশোধনীতে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি।’

‘সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে পাবলিক অফিস বা সরকারি পদ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, সেটিও আরও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। আমরা আশা করি, বিষয়টি ন্যায়সঙ্গতভাবে নিষ্পত্তি হবে এবং ইতিবাচক সমাধান পাওয়া যাবে,’ বলেন তিনি। এর আগে আইসিটি আইনে সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সংক্রান্ত ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর বলেন, সেনা আইন ১৯৫২ এবং আইসিটি আইন ১৯৭৩- দুটোই বিশেষ আইন। ‘এই দুটি বিশেষ আইন মুখোমুখি দাঁড়াবে না। মামলা আইসিটি আইনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আছি। আমরা চাই বিচার প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হোক,’ যোগ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘গুম ও হত্যার শিকার যারা হয়েছেন, তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে। একইসঙ্গে আমাদের কর্মকর্তাদের অধিকারের বিষয়েও আমরা সচেতন। আমরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এগোবো।’ পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর বলেন, ‘যদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে বিচার সেনা আইনের আওতায় হবে, আমরা তার জন্য প্রস্তুত।’

প্রসঙ্গত, গত ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণের পর ৩২ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের ১৫ সেনা কর্মকর্তা আছেন। ১১ অক্টোবর সেনাবাহিনী জানায়, ওই ১৫ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। গুমের মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে আসা ১০ সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিয়েছেন। তারা হলেন- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, কর্নেল একেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সাইফুল ইসলাম সুমন। আরেকটি মামলায় তিন সাবেক ডিজিএফআই কর্মকর্তা- মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুব রহমান সিদ্দিকী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজহার সিদ্দিকী- ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিয়েছেন। অন্য মামলায় অভিযুক্ত দুই সাবেক বিজিবি কর্মকর্তা- লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম এবং মেজর রাফাত বিন আলম মুন-ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিয়েছেন।