বিশেষ আয়োজন : পর্যটন কেন্দ্রগুলো কি নিরাপদ

অব্যবস্থাপনায় কক্সবাজারের পর্যটন

* সেন্টমার্টিন বন্ধ * অপরাধ; অন্ধকার সৈকত * গলাকাটা হোটেল ভাড়া ও খাবারের দাম * দালালদের দৌরাত্ম্য * সৌন্দর্য হারাচ্ছে সমুদ্র সৈকত * বিদেশি টানতে নেই উদ্যোগ

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার অফিস

দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সারাদিন হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে। কিন্তু ঝাউবাগানসহ সৈকতের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপিত বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে বাতি না থাকায় সন্ধ্যার পর সৃষ্টি হয় এক ভীতিকর পরিবেশ। এতে সন্ধ্যার পর সৈকতের অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকাগুলোতে প্রতিনিয়ত ছিনতাই ও ইভটিজিংসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পর্যটন শিল্পের উপর। তবে, ট্যুরিস্ট পুলিশসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি সম্পর্কে প্রশাসন অবহিত রয়েছে। সৈকত এলাকায় স্থাপিত নষ্ট হওয়া বাতিগুলো সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই সমস্যা সমাধানের আশা করছেন তারা।

বৈশ্বিক পর্যটনের সম্ভাবনা থাকলেও কক্সবাজার কেন সেভাবে গড়ে উঠতে পারছে না? এই প্রশ্ন যখন সামনে আসে তখন ভেসে উঠে নানা অব্যবস্থাপনা, অসঙ্গতি, অবহেলা আর পরিকল্পনাহীনতা। এক কথায় বলা চলে, কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের পরতে পরতে লেগে আছে অব্যবস্থাপনার জঞ্জাল! সে কারণে প্রবল সম্ভাবনা সত্ত্বেও কোনোভাবেই এগুতে পারছে না এখানকার পর্যটন শিল্প- এমনটি বলছেন পর্যটন বিশেষজ্ঞরা।

অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত সমুদ্র সৈকত : কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের প্রাণ ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত। এ সৈকতে ঘিরেই এখানকার পর্যটন শিল্প। স্বচ্ছ সমুদ্রের জলরাশির গর্জন আর মন উতাল করা ঢেউ সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষের এখানে টেনে আনে। কিন্তু এমন অমূল্য সৈকত ব্যবস্থাপনায় চরম উদাসীন সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। সৈকতের পরতে পরতে লেগে আছে অব্যবস্থাপনার জঞ্জাল! একে একে দখল হয়ে যাচ্ছে সৈকতের বালিয়াডি। দখল করা বালিয়াড়িতে গড়ে উঠছে দোকানের নামে ঝুপড়ি দোকানপাট! এছাড়া অপরিকল্পিত যত্রযত্র কিটকট, বিচবাইক, ওয়াটারবাইকসহ হকারদের দৌরাত্ম্য। সৈকতের পর্যটক বিচরণের মূল অংশ লাবণী থেকে কলাতলী পর্যন্ত পুরো অংশ এখন পর্যটকদের অস্বস্তিতে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে বছরের পর বছর সাগরে বিলীন হচ্ছে মাইলের পর মাইল বালিয়াড়ি। এতে গত ৫ থেকে ৮ বছরে সৈকতের লাবণী থেকে ডায়বেটিক পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অংশ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। এতে ওয়াকওয়ে, বিদ্যুৎ লাইন এবং বিশাল ঝাউবাগান সাগরের বিলীন হয়েছে। কিন্তু তা রোধে কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। এতে পর্যটকরা প্রত্যাশা সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছে না। এই সৈকতের টানে লাখ লাখ ছুটে আসলেও পুরো সৈকত এখন সূর্য ডুবলেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। সৈকতের আলোকসজ্জার জন্য লাগানো বাতিগুলো বিকল হয়ে গত অন্তত ছয় মাস ধরে এই অন্ধকার পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে।

বিচ ম্যানেজ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টি আর সৈকত বিলীন হয়ে কলাতলী থেকে ডায়বেটিক পয়েন্ট পর্যন্ত লাগানো ১১৯টি ফ্লাডবাতির ৯০ বিকল হয়ে গেছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও বর্তমানে পর্যটন মৌসুম চললেও বাতিগুলো সংস্কার বা প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন।

পাহাড় কেটে হোটেল, বিপর্যস্ত পরিবেশ : পাহাড়-সমুদ্র আর নদী-বনের মেলবন্ধনে কক্সবাজার। কিন্তু একের পর এক পাহাড় কাটা পড়েছে, গড়ে উঠেছে অন্তত পাঁচশ হোটেল-মোটেল। তবে এত কিছুর পরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি পর্যটন। মাঝখান থেকে ক্ষতি হয়েছে মাটি, মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের। পরিবেশের ক্ষতি করে এমন জীবিকা পৃথিবীজুড়ে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখাচ্ছে পরিবেশবান্ধব (ইকো) পর্যটন। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এরইমধ্যে এই জেলায় গড়ে উঠেছে অন্তত ১০টি ইকো রিসোর্ট। এগুলো সাধারণত শহরের বাইরে। গ্রামীণ পরিবেশে বাঁশ, কাঠ ও শন দিয়ে তৈরি। বর্জ্য খাল বা সমুদ্রে ফেলা হয় না। পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, কক্সবাজার পর্যটন এলাকা হওয়ায় যত্রতত্র দালানকোঠা নির্মাণ হচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। এতে ইকো রিসোর্ট নির্মাণ প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

থমকে আছে ইকোট্যুরিজম পার্ক বাস্তবায়ন : দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে ২০১৬ সালে কক্সবাজারে প্রায় ১১ হাজার একর জমিতে তিনটি ট্যুরিজম পার্ক করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। কিন্তু ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি। এমনকি এ নিয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনাও নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেকনাফ সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ৯৬৭ একর, নাফ ট্যুরিজম পার্ক ২৭১ একর এবং মহেশখালীর সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমিতে নির্মাণের কথা ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সোনাদিয়া পার্ক প্রকল্প বাতিল করেছে।

পর্যটন নগরীতে নেই শিশু পার্ক : পর্যটক টানতে যেখানে সব রকমের বিনোদন কেন্দ্র থাকার কথা, সেখানে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে শিশু পার্কই নেই। ২০০০ সালে সমুদ্রসৈকতের ডায়াবেটিস পয়েন্টে শিশু পার্ক নির্মাণের জন্য কক্সবাজার পৌরসভাকে মৌখিক অনুমতি দেয় জেলা প্রশাসন। এরপর শিশু পার্ক নির্মাণের সাইনবোর্ড টানানো হয়। নির্মাণ করা হয় শিশুদের জন্য আটটি রাইড। কিন্তু জেলা প্রশাসনের লিখিত অনুমোদন না পাওয়ায় পার্কটি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।

নিরাপত্তা সংকট : পাহাড়, স্বচ্ছ নীল জলরাশির সাগর ও বিস্তৃত বালিয়াড়ির সৈকতের অপার সৌন্দর্য উপভোগে প্রতিদিন কক্সবাজারে ভিড় করেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা হাজারো ভ্রমণপিপাসু। দিনে সাগরে গোসলের পাশাপাশি সৈকতের বালিয়াড়িতে নানাভাবে আনন্দ উদযাপনে মেতে উঠেন পর্যটকরা। মূলত ১২০ কিলোমিটারের দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সৈকতের কবিতা চত্ত্বর থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এসব পর্যটক সমাগম ঘটে। কিন্তু এই এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোতে স্থাপিত প্রায় ৭০ শতাংশ আলোক বাতি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। ফলে সূর্য ডোবার পরই সৈকতের এই অংশ পর্যটকদের কাছে যতটাই আকর্ষণীয়, ততটাই অজানা আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার। এতে দিনের কক্সবাজার ও রাতের কক্সবাজার ভিন্ন পরিবেশে রূপ নেয়। ছিনতাইকারি ও বখাটেদের দৌরাত্ম্যের কারণে সৈকত এলাকার রাতের কক্সবাজার এখন পর্যটকদের কাছে যেন এক আতঙ্কের নাম। এ নিয়ে ঘুরতে আসা পর্যটকরা বলছেন, নান্দনিক সৌন্দর্য্যরে সৈকতে পর্যাপ্ত আলোক বাতির ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকরা সব জায়গায় নির্বিঘ্নে ঘুরতে পারেন না। আর অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকা দিয়ে হাঁটতে গেলে অজানা ভয় আর অনিরাপত্তা বোধ করেন তারা। এমনকি মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে গত দুই বছর ধরে সেন্টমার্টিন রুটও পর্যটকদের জন্য চরম অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশ থেকে দাবি করা হয়, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা জোর রয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো! সৈকত এবং শহরেন; সব স্থানে ওঁৎপেতে থাকে ছিনতাইকারী, প্রতারক চক্র এবং চোরচক্রসহ নানা অপরাধী চক্র। এসব অপরাধী চক্র প্রতিনিয়ত লক্ষ্যবস্তু বানায় পর্যটকদের। অস্ত্রের মুখে জিম্মি এবং জখম করে সর্বস্ব লুট, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, নারী, ও মাদকের প্রলোভন ফেলে সুযোগ বুঝে সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়া এবং হোটেল ও হোটেলের বাইরে চুরির শিকার হন পর্যটকরা। সর্বশেষ গত ১৯ অক্টোবর টাঙ্গাইলের সাইফুল ইসলাম নামের এক পর্যটককে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাত করে টাকা-মোবাইলসহ সর্বস্ব ছিনিয়ে ছিনতাইকারীর দল। সে কারণে অনেক পর্যটক নিরাপত্তা সংশয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এসেও স্বস্তিতে ঘুরাফেরা করতে পারে না!

সেন্টমার্টিন খুললেও যাচ্ছেন না পর্যটক : দীর্ঘ ৯ মাস বন্ধ থাকার পর সরকারি সিদ্ধান্তে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের দ্বার খুলেছে। তবে গত শনিবার (১ নভেম্বর) যাত্রার প্রথম দিনে কক্সবাজার বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে ছয়টি জাহাজ প্রস্তুত থাকলেও ছেড়ে যায়নি একটিও। গত শনিবার থেকে দ্বীপে জাহাজ চলাচল শুরুর সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল। এতে সীমিত আকারে খুলে দেওয়া হয় পর্যটকের জন্য দ্বীপটির দ্বার। কিন্তু প্রথম দিনেই মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশীয় পর্যটনশিল্পের একটি সম্ভাবনা। দেশি-বিদেশি পর্যটক বরণে কক্সবাজার প্রস্তুত থাকলেও সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করায় কক্সবাজারে পর্যটকশূন্যতা বিরাজ করছে। ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থেকে স্বপরিবারে কক্সবাজার বেড়াতে আসা তাজুল ইসলাম বলেন, মনে করেছিলাম বউ-বাচ্চা নিয়ে প্রথমবারের মতো সেন্টমার্টিন ঘুরে আসব। শুনলাম সকালে গিয়ে বিকালে ফিরতে হবে, দ্বীপে রাতে থাকা যাবে না। এজন্য আর ঝক্কি-ঝামেলায় যাইনি। কক্সবাজার ঘুরেই বাড়ি ফিরব।

এদিকে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার কথা ছিল পর্যটকবাহী জাহাজ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সম্মতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছেড়ে যায়নি একটিও। এর আগে আইনগত কারণে উখিয়ার ইনানী থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ ইনানী এলাকা ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)’ ঘোষিত।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন জানান, আগের নিয়মে নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকেই জাহাজ সেন্ট মার্টিন যাবে।

গলাকাটা বাণিজ্য ও দালালদের দৌরাত্ম্য : কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল ও রেস্টুরেন্টে গলাকাটা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন উপলক্ষে পর্যটকের উপস্থিতি বাড়লেও হোটেল-মোটেলে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে রেস্টুরেন্টগুলোতেও নেওয়া হয় কয়েকগুণ বাড়তি দাম। মূলত সংকটকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের জিম্মি করে গলাকাটা বাণিজ্য করেন। এক্ষেত্রে দালালচক্রও দায়ী। দালাল চক্রের সদস্য রিকশা, অটোরক্সিা, ইজিবাইকসহ অন্যান্য সেক্টরের কিছু ফাঁদে ফেলে হোটেল কক্ষ বুকিংও রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে গলাকাটা দাম আদায় করে। এই গলাকাটা বাণিজ্যের সিন্ডিকেটকে প্রতিরোধ করতে প্রশাসনের কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা জোরদার নেই। তাই দীর্ঘদিন পর্যটকরা হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন।

বিদেশি পর্যটক টানতে নেই উদ্যোগ : বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হিসেবে কক্সবাজারের প্রতি বিদেশি পরিব্রাজকদের আকর্ষণ রয়েছে। সে হিসাবে এখানে বিদেশি পর্যটকদের আনোগোনা রয়েছে। কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে বিদেশি পর্যটক কক্সবাজারে আসছেন না জানান সংশ্লিষ্টরা। কি পরিমাণ বিদেশি পর্যটক কক্সবাজার বেড়াতে আসে তারও সুনির্দিষ্ট তথ্য সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরে নেই। বিদেশি পর্যটকদের সমুদ্র সৈকতে আলাদা জোন তৈরির নানা উদ্যোগের শোনা যায়। কিন্তু তা কখনও আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে এই বিষয়ে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা এবং উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এতে অঢেল সম্ভাবনা থাক সত্ত্বেও সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়ে বিদেশি পর্যটকদের অভিজ্ঞ গাইড এমডি ম্যাক্স বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন বিদেশি পর্যটকদের গাইড করে আসছি। আমার অনুমান মতে, বিদেশি পর্যটক আগমন অতীতের চেয়ে কমেছে। অতীতে সৈকতে নিয়মিত বিদেশি পর্যটকদের দেখা মিলতো। কিন্তু এখন কালেভাদ্রে দেখা মিলে।

অকর্মণ্য বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি : কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের প্রধান আকর্ষণ সমুদ্র সৈকত রক্ষায় রয়েছে ‘বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ নামের একটি সংস্থা। এই সংস্থার সভাপতি জেলা প্রশাসক। সমুদ্র সৈকত রক্ষাবেক্ষণ ও পর্যটক সুবিধা নিশ্চিতকরণ সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করা এই সংস্থার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এই সংস্থার তোড়জোড় থাকলেও কার্যকরী ভূমিকা নেই। যার দরুণ, অবৈধ ঝুপড়ি দোকান, যত্রযত্র কিটকট, বিচবাইক ও ওয়াটারবাইকের প্রভাবে ম্লান হয়ে পড়েছে সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য। সেইসঙ্গে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় রয়েছে খোদ বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। জেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও ভূমিকায় সমুদ্র সৈকতে উল্লেখিত সব অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

সচেতন মহলের প্রতিক্রিয়া : কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প নিয়ে এমন অব্যবস্থাপনা নিয়ে স্থানীয় সচেতন মহল বেশ ক্ষুব্ধ। এই অব্যবস্থাপনা রোধে প্রায়ই সময় সুশীল সমাজ ও সচেতন লোকজন প্রতিক্রিয়া দেখান। বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ ও পরামর্শ দেন। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিবাদ ও পরামর্শ আমলে নেয় না সংশ্লিষ্টরা। তবে চাপ সৃষ্টি না করলে এতদিনে পর্যটনের অযোগ্য হয়ে পড়তো কক্সবাজার- এমনটি মনে করেন সচেতন মহল। অনেকেই বলছেন, প্রশাসনের প্রধান ভূমিকা আর কিছু অসাধু-লোভী লোকজন পর্যটন শিল্পকে গড়ে উঠতে দিচ্ছে না। অধিকন্তু ধ্বংস হচ্ছে এ শিল্প। এ ব্যাপারে কক্সবাজার সিটি কলেজের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের প্রধান ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ মঈনুল হাসান পলাশ বলেন, ‘এই পর্যটন চলছে একেবারে অপরিকল্পিত ও অব্যস্থাপনায়। জেলা প্রশাসন এই শিল্পকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না বরং ক্ষতি করেই চলছে। তারা অর্থের লোভে এই শিল্পকে লুটেপুটে খাচ্ছে। উন্নয়নের তাদের কোনো ভূমিকা নেই; কিন্তু ক্ষতি করতে তারা সিদ্ধহস্ত!’ আরেক পর্যটন বিশেষজ্ঞ মুফিজুর রহমান বলেন, ‘আশির দশকে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়। ২০০০ সাল পর্যন্ত এই শিল্প বেশ সম্ভাবনা জাগিয়েছিল। কিন্তু এরপর লোভের আক্রোশে পড়ে এই শিল্প। এরপর সমুদ্র সৈকত গিলে খেতে শুরু করে প্রশাসন ও সুবিধাবাদীরা। ক্রমান্বয়ে এই শিল্পকে মরণদশায় পরিণত করেছে তারা।

এসব বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ জানিয়েছেন, এরইমধ্যে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী অল্প কয়েকদিনের মধ্যে নষ্ট হওয়া বৈদ্যুতিক খুঁটি সংস্কার ও বাতি লাগানোর পাশাপাশি কোথায় কোথায় নতুন করে আলোর ব্যবস্থা করা জরুরি তা চিহ্নিত করা হয়েছে। সমস্যা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস প্রশাসনের। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলম বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমায় কক্সবাজার সৈকতে। কিন্তু পর্যাপ্ত আলোকায়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে বিশ্বের দীর্ঘতম এই সৈকত হারাবে তার রাতের সৌন্দর্য, ক্ষতিগ্রস্ত হবে পর্যটন ব্যবসাও। অন্ধকারে ঢাকা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত আলোকিত করার কাজ চলমান রয়েছে।

সেন্টমার্টিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১ নভেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে ‘কর্ণফুলী এক্সপ্রেস’ ও ‘বারো আউলিয়া’ নামে দুটি জাহাজ সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনুমোদনের বিষয়টি জাহাজ মালিককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরও জাহাজ মালিক অনুমোদনপত্রটি নিয়ে যায়নি।