অবকাঠামো ও নিরাপত্তা সংকটে পর্যটক হারাচ্ছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পটুয়াখালী প্রতিনিধি
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের অপরূপ সাগরকন্যা কুয়াকাটা। একই সৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার বিরল সুযোগের কারণে এ সৈকত দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুয়াকাটা ও এর আশপাশের পর্যটন স্পটগুলো হারাচ্ছে আগের প্রাণচাঞ্চল্য। অবকাঠামোগত দুরবস্থা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, সড়ক ও নৌপথের ভোগান্তি এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের কারণে দিন দিন কমছে পর্যটকের আগমন। প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সৈকতের সৌন্দর্য এখনও মোহময়, কিন্তু পর্যটন সেবা ব্যবস্থার দুরবস্থায় অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরছেন। ঢাকা থেকে আগত পর্যটক ফারহানা ইসলাম বলেন, ‘কুয়াকাটা দেখতে দারুণ লাগে, কিন্তু সৈকত পরিষ্কার রাখা হয় না। রাতে আলো কম, নিরাপত্তা নেই, তাই পরিবার নিয়ে বের হতে ভয় লাগে।’ স্থানীয় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিনের মতে, আগে মৌসুমে হোটেল বুকিং পাওয়া যেত না, এখন অর্ধেক রুম খালি থাকে। পর্যটন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না আনলে এ খাত আরও পিছিয়ে যাবে।
কুয়াকাটার পাশে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম পানি জাদুঘর উপকূলের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এখানে সংরক্ষিত আছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, মাছ, শামুক- ঝিনুক ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষণার উপকরণ। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান অনেক সংগ্রহ। জাদুঘরের এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, জনবল ও বাজেট সংকট থাকায় অনেক কিছু ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। অথচ এটি দেশের উপকূলীয় পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হতে পারত। কুয়াকাটা থেকে নৌপথে কিছু দূরেই অবস্থিত জাহাজমারা সৈকত। নীল সাগর, ঝাউবন আর নিরব পরিবেশে অনন্য এই সৈকত একসময় জাহাজ ভাঙার জন্য পরিচিত ছিল। বর্তমানে এটি শান্ত ও নির্জন সৈকত হলেও পর্যটকদের কাছে এখনও অচেনা। স্থানীয় যুবক সোহেল হাওলাদার বলেন, রাস্তা খানাখন্দে থাকায় এখানে আসা যায় না সহজে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে এটা কুয়াকাটার চেয়েও জনপ্রিয় হতে পারবে। রাঙ্গাবালী উপজেলার পশ্চিমে অবস্থিত চর তুফানিয়া, একেবারে প্রাকৃতিক রূপে ভরা এক অনিন্দ্য সুন্দর জায়গা। সাদা বালু, নীল আকাশ আর সাগরের ঢেউয়ের মিলনে গড়ে উঠেছে স্বপ্নের পরিবেশ। কিন্তু সেখানে পৌঁছানো সহজ নয়। নেই নিরাপদ নৌঘাট, বিশ্রামাগার বা খাবারের দোকান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান বলেন, তুফানিয়া দেখলে মনে হয় বিদেশে এসেছি, কিন্তু যাত্রাপথ খুব ঝুঁকিপূর্ণ। নৌযান দুর্ঘটনার ভয় সবসময় থাকে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দক্ষিণ প্রান্তে সোনার চর, এক বিস্তীর্ণ দ্বীপ যেখানে আছে ঝাউবন, বালুর টিলা, পাখির কলতান আর নীল সাগরের ছোঁয়া। কিন্তু এখানেও মূল বাধা যোগাযোগ ব্যবস্থা। স্পিডবোট কিংবা লঞ্চই একমাত্র ভরসা, তাই পর্যটক আসতে চান না ঝুঁকি নিয়ে। স্থানীয় জেলে হাশেম আলী বলেন, প্রতি সপ্তাহে কয়েকজন পর্যটক আসে, কিন্তু ঝড় বা খারাপ আবহাওয়া হলে কেউ আসতে পারে না। রাস্তা বা ফেরিঘাট হলে এখানেও পর্যটন বাড়বে। পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. শহীদ হোসেন চৌধুরী বলেন, কুয়াকাটা ও আশপাশের পর্যটন এলাকাগুলোকে ঘিরে সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে। সোনার চর ও জাহাজমারাকে ইকো-ট্যুরিজম জোন হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে।
পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আনোয়ার জাহিদ বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশের উপস্থিতি কুয়াকাটায় জোরদার করা হয়েছে। নতুন পর্যটন স্পটগুলোতেও নিরাপত্তা টহল চালুর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন ও আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আলম বলেন, এই পাঁচটি স্পটকে একটি পর্যটন সার্কিটে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। কুয়াকাটা থেকে সোনার চর পর্যন্ত যোগাযোগ উন্নয়নই হতে পারে সেই রূপান্তরের সূচনা। কুয়াকাটা থেকে রাঙ্গাবালীর যোগাযোগ ব্যাবস্থা দ্রুত বাস্তবায়ন, সোনার চর ও তুফানিয়ায় নিরাপদ নৌঘাট ও বিশ্রামাগার নির্মাণ পানি জাদুঘর আধুনিকীকরণ ও ট্যুর গাইড প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনসহ ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ তদারকি বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন। সর্বোপরি সাগরকন্যা কুয়াকাটা থেকে শুরু করে সোনার চর পর্যন্ত পটুয়াখালীর উপকূল প্রকৃতির এক আশ্চর্য উপহার। কিন্তু সেই সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন পরিকল্পিত অবকাঠামো, নিরাপত্তা ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা। অন্যথায় কুয়াকাটার সূর্যোদয়ের মতোই নিঃশব্দে হারিয়ে যাবে এই উপকূলের আলো, আর পর্যটকরা ফিরবেন হতাশ মনে।
