রাজধানীতে বিএনপির বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা
‘জামায়াতের গণভোটের দাবি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র’
* জিয়ার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ * ‘গণতন্ত্রকে আবার ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছে’
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি দলের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিকে ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করে তিনি বলেন, গণভোট হলে নির্বাচনের দিনই হতে হবে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই নির্বাচন হতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশের মানুষ কিছু মেনে নেবে না। গতকাল শুক্রবার ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তরের যৌথ উদ্যোগে শোভাযাত্রার আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। পরে শোভাযাত্রাটি কাকরাইল নাইটেঙ্গল রেস্তোরাঁর মোড় থেকে বিকাল ৪টায় শুরু হয়। এটি শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, বাংলা মোটর হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের মোড়ে এসে শেষ হয়।
শোভাযাত্রায় অংশ নেন- দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খানসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনসহ নেতাকর্মীরা এতে অংশ নেয়। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের প্রতিকৃতি, পোস্টারসহ জাতীয় পকাতা নিয়ে আসা নেতাকর্মীদের হাতে হাতে ছিল ধানের শীষ ও বিএনপির পতাকা।
কর্মসূচিকে ঘিরে বেলা ২টা থেকে নয়াপল্টন বিএনপির কার্যালয়ের সামনে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীদের জড়ো হতে দেখা গেছে। এসময় নেতাকর্মীরা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের নামে বিভিন্ন স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে তুলেন। শোভাযাত্রায় জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত ফেস্টুন ও ব্যানার নিয়ে অংশ নেন নেতাকর্মীরা। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকায় মনোনীত সম্ভাব্য প্রার্থীরা মিছিলসহ ধানের শীষ নিয়ে শোডাউন দিতে দেখা গেছে।
শোভাযাত্রার আগে সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একটা রাজনৈতিক দল কয়েকটি দল নিয়ে জোট বানিয়েছে। তারা নির্বাচনের আগেই গণভোট দিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। দুটি ভোট একসঙ্গে করতে গেলে অনেক টাকা খরচ হবে। যারা নির্বাচনের আগে গণভোট চাচ্ছে, তারা এর মাধ্যমে নির্বাচনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছে।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ব্যাহত করতে অন্তবর্তীকালীন সরকার নিজেরাই একটা অবস্থা তৈরি করছে বলে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, দুর্ভাগ্য আমাদের অন্তর্বর্তীকাল সরকার যাকে আমরা সম্পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি, তারা আজকে নিজেরাই একটা অবস্থা তৈরি করছে যাতে করে নির্বাচন ব্যাহত হয়।
সংস্কার প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির জন্ম হয়েছে সংস্কারের মধ্য দিয়ে। আমাদের নেতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম তিনি সংস্কারের সূচনা করেছেন। আর আজকে তারেক রহমান নতুন সংস্কারের ৩১ দফা দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়ে আমরা একটা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
শোভাযাত্রায় খাঁচায় বন্দি অবস্থায় প্রতীকী শেখ হাসিনাকে প্রদর্শন করেন নেতাকর্মীরা। দেখা গেছে, একটি খাঁচার ভেতরে বন্দি রয়েছেন প্রতীকী শেখ হাসিনা। তার মুখে দুটি রাক্ষস দাঁত লাগানো ছিল। খাঁচায় লেখা আছে, আমি ভোট চোর, আমি দলের সমস্ত নেতার্মীদের ফেলে পালিয়ে যাই। এভাবেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খাঁচার ভেতরে রেখে প্রদর্শন করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি প্রতীকী খাঁচাও প্রদর্শন করা হয়। এর ভেতরে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের খাঁচার ভেতরে রেখে প্রদর্শন করা হয়।
গণভোট নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং কয়েকটি দলের দাবির প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা যে বিষয়গুলোতে একটা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যে আমরা আমাদের যেগুলো আপত্তি থাকবে অর্থাৎ যেগুলো নোট অব ডিসেন্ট থাকবে, সেখানে তা লিপিবদ্ধ থাকবে। সেটা সেখানে রাখা হয়নি। আমরা সেটা গ্রহণ করিনি তা আমরা সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছি।
পরবর্তীকালে হঠাৎ করে উপদেষ্টা কাউন্সিলের একজন সদস্য সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ‘সাতদিন সময় দেওয়া হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা নিজের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’ তাহলে এতদিন ধরেই সাত মাস ধরে যে জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবার জন্য ঐক্যমত্য কমিশন বসলেন, সমস্ত সংস্কারের প্রস্তাবকে আলাপ-আলোচনা করলেন; তাহলে সেটা কিভাবে হল? টাকা খরচ করে আপনারা যেটা করলেন, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সমাধান হয়নি।
বিএনপি মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, মহানগর দক্ষিণে বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বক্তব্য রাখেন।
শোভাযাত্রাকে ঘিরে নয়াপল্টন এবং এর আশপাশ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে মোতায়েন থাকতে দেখা গেছে। পুলিশের পাশাপাশি আইনশঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদেরও দেখা গেছে।
জিয়ার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ : ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে সকালে শেরে বাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে বিএনপি। পরে সাংবাদিকদের কাছে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে আবারও গণতন্ত্র ধ্বংসের চক্রান্ত হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গণভোট প্রশ্নের বিএনপির সঙ্গে আলোচনার যে প্রস্তাব বিএনপিকে দিয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য গত বৃহস্পতিবার দলের স্থায়ী কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত খুব পরিস্কার আপনাদের জানিয়ে দিয়েছি। ওটাই আমাদের বক্তব্যে ।
এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনকে নিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, আবদুস সালাম আজাদসহ মহানগর উত্তর বিএনপিন আহ্বায়ক আমিনুল হক, দক্ষিণের আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনসহ অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির পুষ্পস্তবক অপর্ণের পরে মহানগর বিএনপি, মুক্তিযোদ্ধা দল, মহিলা দল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, জাসাস, ড্যাব, এ্যাব, ছাত্র দল, তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আলাদা আলাদাভাবে জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করে।
গণতন্ত্রকে আবার ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছে : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আবার ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল শুক্রবার ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এ কথা বলেন মির্জা ফখরুল।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশে বিভিন্ন রকম, এই গণঅভ্যুত্থানের পরে বিভিন্ন রকমভাবে একটা প্রচেষ্টা, চক্রান্ত চলছে গণতন্ত্রকে আবার ধ্বংস করার জন্য।’ ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের’ তাৎপর্য-প্রেরণা নিয়ে কথা বলেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস আমাদের সেই পথেই যেতে অনুপ্রাণিত করে, যে পথে সত্যিকার অর্থে আমরা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারব। একটা সমৃদ্ধ রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারব। জনগণের ভোটের অধিকারকে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে পারব। বিচারের অধিকার নিশ্চিত করতে পারব। সেই লক্ষ্যেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, বিএনপি এগিয়ে যাব।’ বিএনপি সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন দলটির মহাসচিব। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে অভিহিত করেন মির্জা ফখরুল। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির মহাসচিব বলেন, জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি থেকে উদ্ধার করে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব অর্পণের কাজটি বাংলাদেশের অগ্রগতির মোড় ঘোরানো দিক ছিল। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। মির্জা ফখরুল বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার চার বছরে জিয়াউর রহমান দেশে আমূল পরিবর্তন আনেন। তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন, তা দেশকে পরবর্তীকালে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
