বাড়ছে অস্ত্রের ঝনঝনানি দুশ্চিন্তায় প্রশাসন

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও খুলনায় গুলিতে কমপক্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রভাব, মাদককারবার, চাঁদাবাজি ও এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বেড়েছে। ফলে গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি দমাতে বিশেষ অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো বিরোধের জেরে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লড়াইয়ে এসব গুলির ঘটনা ঘটছে। মাদক ও চাঁদাবাজি সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে একে অন্যের ওপর হামলা চালাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর দ্বন্দ্ব নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর বহু সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে আসেন। তারা আবার জড়িয়ে পড়েন অপরাধে। এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ৫টি থেকে ২০টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। এই সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন, যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অবৈধ অস্ত্রের অবাধ ব্যবহারের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। এসব অস্ত্রের ঝনঝনানি দমাতে মাঠপর্যায়ে টহল ও অভিযান জোরদার করা হয়েছে। তবে একাধিক অঞ্চলে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এখনও সক্রিয় থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সহিংসতার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সেজন্য নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত অস্ত্রবিহীন পরিবেশ নিশ্চিতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করা। অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার শুধু নির্বাচনি সহিংসতা নয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকেও বড় ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

সম্প্রতি, গত ৩ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে শত্রুতা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের গুলিতে শিপন ও ইয়াছিন নামে দুজন নিহত হয়। আর বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে নির্বাচনি জনসংযোগে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন চট্টগ্রাম-৮ আসনের প্রার্থী ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহসহ পাঁচজন। এই পাঁচজনের মধ্যে গুলিতে নিহত হন ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ার হোসেন। পুলিশ বলছে, তার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। তিনি গত বছরের ৫ আগস্টের পর জামিনে বের হন। সরোয়ার বিএনপির বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে অংশ নিতেন। পরিবার বলছে, সরোয়ার যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে কোনো পদে ছিলেন না। তবে বিএনপি ও যুবদলের নেতারা বলছেন, সরোয়ার তাদের কর্মী নন। মিছিল-সমাবেশে অনেকেই অংশ নেয়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে খুলনার রূপসায় সোহেল হাওলাদার (৪৫) নামে এক প্রবাসী যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গোলাগুলির ঘটনা জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীসহ গাজীপুর, সাভার, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা খুলনা ও সীমান্তবর্তী এলাকা বেনাপোলে চাঁদাবাজি, মাদককারবারী ও রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অবৈধ অস্ত্রের প্রদর্শনের প্রবণতা বেড়েছে।

জানা গেছে, গত ২৯ অক্টোবর গাজীপুরের নাওজোড় এলাকা থেকে ৮টি বড় ছোরা, ১৯টি ছোট ছোরা, ৫টি বড় চাপাতি, ৫টি ছোট চাপাতি, ২টি লোহার হাঁসুয়া, ৫টি রামদা, ১টি সোজা রামদা, ২৭টি নকল ডায়মন্ড ও কিছু গাঁজাসহ দুইজনকে আটক করে যৌথ বাহিনী। ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাউজানে নোয়াপাড়া ইউনিয়নের বিএনপির সমর্থক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কামালের বাড়ি থেকে ১১টি বন্দ্কু ও ২৭টি দা- ছুরি উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৫ নভেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় দুটি পিস্তল, তিনটি ম্যাগজিন, চার রাউন্ড গুলি, চারটি ওয়াকিটকি, চারটি লাঠি, দুটি ইলেকট্রিক শক মেশিন, একটি হ্যামার নিল গান এবং একটি চাকুসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩১ অক্টোবর সুনামগঞ্জের ছাতকের সীমান্তবর্তী এলাকা ছনবাড়ী থেকে বিজিবি ২৫০ গ্রাম প্লাস্টিক বিস্ফোরক ও দুইটি ডেটোনেটর উদ্ধার করে। গত শুক্রবার মধ্যরাতে রাজধানীর শনির আখড়ার গোবিন্দপুর এলাকায় যৌথ অভিযানে ১টি ৭.৬৫ মি.মি. পিস্তল, ২টি মোবাইল ফোন, নগদ ৮০ হাজার টাকা এবং কয়েকটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অভিযানে দুই সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সর্বশেষ সুন্দরবনের বনদস্যুদের অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ বিল্লাল গাজী নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গত ২৬ অক্টোবর সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গোয়েন্দা সংস্থা ও রেলওয়ে পুলিশের সহায়তায় রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে একটি বিশেষ অভিযান চালানো হয়। এ সময় রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি নির্দিষ্ট বগি তল্লাশি করে ৮টি বিদেশি পিস্তল, ১৬টি ম্যাগাজিন, ২৬ রাউন্ড অ্যামুনিশন, ২.৩৯ কেজি গান পাউডার এবং ২.২৩ কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক উদ্ধার করে। অস্ত্রের চালানের বিষয়ে সেনাবাহিনীর অভিযান জোরদার করার পাশাপাশি নজরদারি আরও বাড়ানো হবে জানিয়ে জেনারেল অফিসার কমান্ডিং, আর্মি সদর দপ্তরের ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ড (জিওসি আর্টডক) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান বলেছেন, ‘আমাদের এমন একটা প্রস্তুতি থাকতে হবে যাতে অস্ত্রের চালান ঢাকায় না আসতে পারে এবং কিছু যদি আসেও সেটা যেন আমরা ডিল করতে পারি।’

ঢাকায় আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের মাধ্যমে নির্বাচনে নাশকতা হতে পারে কি না জানতে চাইলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি যেখান থেকে ঢাকামুখী অস্ত্রের চালান ধরা পড়েছে এটা অবশ্যই আমাদের কনসার্ন করা উচিত। আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত, তবে একই সঙ্গে অস্ত্র ধরা পড়েছে এটাও সাফল্য।’ গত বুধবার সেনা সদর দপ্তরে সেনাবাহিনীর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সেনা সদরের পরিচালক (মিলিটারি অপারেশন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের পর লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ উদ্ধার হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, এখন পর্যন্ত ৪৮৪টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে র‌্যাবের লুট হওয়া ১৬৮টি অস্ত্রের মধ্যে ৯০টি, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ২২৮টি উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ১৬৬টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গোলাবারুদের ক্ষেত্রে র‌্যাবের ৭ হাজার ৩০৩ রাউন্ড, পুলিশের ১১ হাজার ৯৪১ রাউন্ড উদ্ধার করা হয়েছে। আর অবৈধ গোলাবারুদ ১ হাজার ২৮০ রাউন্ড উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধার-সংক্রান্ত মামলায় ৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা : গত বুধবার পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, সরকার বাংলাদেশ পুলিশের লুণ্ঠিত বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করেছে। লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রকৃত সন্ধানদাতাদের পুরস্কৃত করা হবে। পুরস্কারের পরিমাণ এলএমজি ৫ লাখ টাকা, এসএমজি দেড় লাখ টাকা, চায়না রাইফেল এক লাখ টাকা এবং পিস্তল ও শটগান ৫০ হাজার টাকা। আর প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য পুরস্কার ৫০০ টাকা। আরও জানানো হয়, লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রকৃত সন্ধানদাতাকে নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে। সন্ধানদাতার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড প্ল্যানিং শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এটা অভিযানে আরও সুফল বয়ে আনবে।

দেশজুড়ে অস্ত্রের প্রদর্শনীর বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইসফাক ইলাহি বলেন, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলছে। এভাবে চলতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটতে পারে। পুলিশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সক্ষমতা এখনও স্বাভাবিক হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জোরেসরে অভিযান চালাতে হবে। যাতে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরে।