কারও দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন করা সরকারের কাজ নয়
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব। অবশ্যই কারও দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়।
‘হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন-২০২৫’ এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন তারেক রহমান। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্য জোটের আয়োজনে এ সম্মেলন হয়। সম্মেলনে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন ও মঠ-মন্দির পরিচালনা কমিটির নেতা- কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ বেদ ও গীতা পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর অতিথিরা প্রদীপ প্রজ্বালন করেন।
দেশ অস্থিতিশীল হলে পরাজিত, পলাতক ফ্যাসিবাদী অপশক্তির পুনর্বাসনের পথ সুগম হতে পারে বলে সতর্ক করেন তারেক রহমান। এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘গুপ্ত রাজনীতি’ সম্পর্কে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ফ্যাসিবাদের রোষানল থেকে বাঁচতে ফ্যাসিবাদবিরোধীদের কেউ কেউ ‘গুপ্ত কৌশল’ অবলম্বন করেছিল। একইভাবে পতিত- পরাজিত ফ্যাসিবাদী অপশক্তিও বর্তমানে ‘গুপ্ত কৌশল’ অবলম্বন করে দেশের গণতন্ত্রে উত্তোরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করে কি না, এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান রাখছেন।
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গী কারও কারও ভূমিকা দেশে ‘আপনার, আমার, আমাদের’ বহু মানুষের অধিকার ও সুযোগকে বিনষ্ট করার হয়তো একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পতিত ও পলাতক অপশক্তিকে কোনো সুযোগ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘গুপ্ত বাহিনীর সেই অপকৌশল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যতম প্রধান কৌশল হচ্ছে, একটি ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য বজায় ও বহাল রাখা।’ সে জন্য বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকার এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গীদের সহযোগিতা ও সমঝোতার দৃষ্টিভঙ্গি সমুন্নত রেখেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি বরাবরই ‘একটি শান্তিকামী, সহনশীল, গণমুখী’ রাজনৈতিক দল বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ভিন্ন দল ও মতের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা, এটি বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। দেশের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই বিএনপির রাজনীতি বলেও দাবি করেন তিনি।
নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে স্বল্প আয়ের মানুষদের সহায়তার জন্য ৫০ লাখ ‘ফ্যামিলি কার্ড’ বিতরণ এবং তরুণদের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা হবে বলে ঘোষণা করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভাষাশিক্ষা দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে দেশে এবং বিদেশে কাজের ব্যবস্থার পরিকল্পনা আমরা এর মধ্যে হাতে নিয়েছি।’
বাংলাদেশে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্যের বন্ধনই আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সৌন্দর্য।’ এই বৈচিত্র্যময় সমাজে ঐক্যসূত্র বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে এই বাংলাদেশে আপনার যতটুকু অধিকার, আমারও ঠিক ততটুকুই অধিকার। কারও বেশি, কারও কম, তা নয়।’
তিনি বলেন, পলাতক স্বৈরাচারের শাসনামলে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান- ডান বা বাম, বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী কেউই নিরাপদ ছিল না। উদাহরণ টেনে বলেন, ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে এবং ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ঘটে যাওয়া হামলার মতো কোনো ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত বা বিচার হয়নি। গত দেড় দশকে তিনি ও তার নেতারা দেশের সুশীল সমাজ এবং সর্বদলীয় ও সর্বধর্মীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি নাগরিক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন, যাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপাসনালয় বা বাসাবাড়িতে সংঘটিত প্রতিটি হামলার নেপথ্য ঘটনা উদ্ঘাটন করে সুষ্ঠু বিচার হয়।
তবে সেই দাবির কোনো বাস্তবায়ন হয়নি, কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত কমিশনও গঠন করা হয়নি। এ কারণেই বিএনপি মনে করে- ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন ছাড়া সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু— কোনো নাগরিকেরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একমাত্র ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনই দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।’
তারেক রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা একটি বড় সুযোগ। তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের কিছু সহযোগীর কর্মকাণ্ড দেশের অনেক মানুষের অধিকার ও সুযোগ ক্ষুণ্ণ করছে। দেশ অস্থিতিশীল হলে অতীতে পরাজিত ও পলাতক ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরায় উত্থানের পথ সুগম হতে পারে। এ সময় তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের উত্থাপিত বিভিন্ন দাবি পূরণের আশ্বাস দেন।
মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্য জোটের আহ্বায়ক সোমনাথ সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবিগুলো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে তুলে ধরেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্য জোটের সদস্যসচিব ও মুখপাত্র কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল, সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক সমেন সাহা, হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, হিন্দু ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কান্তি সরকার, মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা সুবর্ণা রানী ঠাকুর প্রমুখ।
