৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ভেঙে পড়তে পারে সবকিছু

* ঢাকার পুরোনো ভবনগুলোর ৯০ শতাংশ বিল্ডিং কোড মানেনি * যে কোনো সময় দেশে বড় ভূমিকম্প হতে পারে : রুবাইয়াত কবির * ঢাকার ২১ লাখ ভবন পরীক্ষা করা দরকার এখনই : অধ্যাপক আনসারী * অভ্যন্তরে স্মরণকালে এত বড় ভূমিকম্প আর হয়নি : হুমায়ুন আখতার

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলের মাত্র ছিল ৫ দশমিক ৭। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্পের মাত্রা ৫ দশমিক ৭ কাগজে-কলমে মাঝারি মনে হলেও বাস্তবে এর প্রভাব জনমনে বিরাট আতঙ্ক তৈরি করে। এই ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য সজাগ হওয়ার বার্তা বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবকিছু ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে।

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, প্রায় ৯০ ভাগ পুরোনো ভবনে বিল্ডিং কোড না মানায় ঢাকা ও পুরান ঢাকা ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

যে কোনো সময় দেশে বড় ভূমিকম্প হতে পারে : বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির বলেছেন, ঢাকা এবং এর আশপাশে বিগত কয়েক দশকে সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্পের মধ্যে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প। এই সময়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ৪ থেকে ৫ মাত্রার সামান্য বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে এগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের বাইরে। তিনি আরও জানান, ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলে একাধিক বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। যা প্রমাণ করে যে, এটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। যে কোনো সময় বাংলাদেশে আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। ঠিক কবে হবে সেটা আমরা বলতে পারি না।

ঢাকার ২১ লাখ ভবন পরীক্ষা করা দরকার, এখনই- অধ্যাপক আনসারী : পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেওয়া ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পকে ‘ভবিষ্যতের বড় ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী। শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ঢাকায় যে বিপর্যয় ঘটে যাবে, সেই বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলছেন, ‘বিল্ডিংগুলো এখনই চেক করা দরকার। বিশেষ করে ঢাকার এ ভবনগুলোর চেকিং ইমিডিয়েটলি দরকার।’ এই প্রকৌশলী বলছেন, ‘এখানে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না, রাজউককে দিয়ে সাধারণ মানুষকে জানান দেবে, সব ভবন চেক করে সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে যে বিল্ডিংগুলো বিল্ডিং কোড অনুযায়ী হয়েছে।’ অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ‘আজকের (শুক্রবার) ভূমিকম্পটা বলতে পারি একটা ফোরশক। অর্থাৎ বড় ভূমিকম্প আসার আগে যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, তার অন্যতম।’

১৮৯৭ সালে এই ভূখণ্ডে ৮.১ মাত্রার ভূমিকম্পের ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এমন ভূমিকম্প আড়ইশ থেকে তিনশ বছর পর পর আসে। ১৯৩০ সালের পর এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। কিন্তু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে।’ শুক্রবারের ভূমিকম্পে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ভবনে ফাটল ধরার প্রসঙ্গ ধরে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এমন ক্ষয়ক্ষতি হবেই। ঢাকা শহরে প্রায় ২১ লাখের মত বাসা রযেছে। তারমধ্যে ১৫ লাখ একতলা দোতলা বাসা। চার থেকে ছয় তলা ভবন প্রায় ৬ লাখের মত, দশতলা, ২০ তলাও রয়েছে।’

একটি বড় ভবন ধসে পড়লে কতটা ক্ষতি হতে পারে, তা বোঝাতে গিয়ে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেন অধ্যাপক আনসারী। সেজন্য সরকারকে এখনই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার তাগাদা দিচ্ছেন তিনি। তার মতে, ঢাকার ভবনগুলোর অবস্থা কেন পরীক্ষা করা দরকার, শুক্রবারের ভূমিকম্প তা মনে করিয়ে দিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘আজকের (শুক্রবার) ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের যত বিল্ডিংয়ের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, স্থাপনা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ভবন দেবে গেছে, ফাটল হয়েছে। রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রায় যে ক্ষতি হয়েছে, ৭ মাত্রার হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে, ভেঙে যাবে ভবন, হতাহত হবে। ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এমন ভূমিকম্প হলে ২-৩ লাখ মানুষ হতহাত হবে, ঢাকা শহরের ৩৫% ভেঙে পড়ার শঙ্কা আছে, অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।’

বিপর্যয় এড়াতে ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করার ওপর জোর দিয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘কোনটি ঝুঁকিপূর্ণ দেখে রিপেয়ার করতে হবে, তারপর সার্টিফিকেট দিতে হবে। এখন থেকে গুরুত্ব সহকারের চেকিং করলে, বিল্ডিংগুলোকে সার্টিফিকেট দিলে, কালার ক্লাসিফিকেশন করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এটাকে দেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্মরণকালে এত বড় ভূমিকম্প হয়নি। মাটির ওপর কম্পনের যে তীব্রতা, এটা স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি। একজন কাজের লোক বললো, গাছপালা যেভাবে দোলে, বিল্ডিং এভাবে দুলছে। এটির গভীরতা ছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার।

তিনি বলেন, এর আগে ২০০৩ সালে রাঙ্গামাটিতে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি বরকল ইউনিয়নে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এটিও অনেক শক্তিশালী ছিল। তবে ১৯১৮ সালে দেশের অভ্যন্তরে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার আরও বলেন, আমরা সরকারকে বারবার বলে আসছি ভূমিকম্পে মহড়ার বিকল্প নাই। সরকার ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকার্যের জন্য কোটি কোটি টাকার বাজেট রাখে, সেখান থেকে দুর্নীতি করতে পারে। কিন্তু যথাযথ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।