পরিস্থিতি উদ্বেগজনক আতঙ্কে নগরবাসী

চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু উদ্বেগজনক আকারধারণ করেছে। এ নিয়ে নগরবাসীর মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সম্প্রতি নগরজুড়ে মশার উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় এমন শঙ্কায় দিন পাড় করছে নগরবাসী। এ নিয়ে অনেকে সিটি কর্পোরেশনকে দোষারোপ করছেন আবার কেউ কেউ বলছেন নিজেদের আশপাশের আঙিনা নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার রাখলে হয়তো এমন অবস্থা হতে দ্রুত মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কমলেও বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। বন্দর নগরীতে চলতি বছর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩ হাজার ৭৬২ জন এবং চিকুনগুনিয়ায় ৩ হাজার ৬৭২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত কেউ মারা না গেলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ২০ জন মারা গেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্দর নগরীর ২৫ এলাকার বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়। তাদের পরিচালিত সম্প্রতি এক জরিপে এসব এলাকা ডেঙ্গুর অন্যতম ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ এলাকাকে অতিঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৬০ শতাংশই এসব এলাকার বাসিন্দা। এর মধ্যে কয়েকটি আবাসিক এলাকাও রয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। এরপরও সিটি কর্পোরেশন লোক দেখানো কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দ্রুত মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার শঙ্কা করছে স্বাস্থ্য প্রশাসন।

হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের ওপর সর্বোচ্চ জোর দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে। পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করা, পানি, ময়লা-আবর্জনা যেন জমে না থাকে, নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, অক্টোবরের প্রথম ২৫ দিনেই আট শতাধিক ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৪০ জন, মারা গেছেন ১০ ব্যক্তি। চট্টগ্রামে চলতি বছর এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ৩০১ জন, মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের।

জরিপের তথ্যানুযায়ী, ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ নগরের ২৫টি এলাকা হলো- বন্দর, কোতোয়ালি, কেপিজেড, হালিশহর, সদরঘাট, বাকলিয়া, বায়েজিদ, পাহাড়তলী, ডবলমুরিং, খুলশী, পাঁচলাইশ, আকবরশাহ, চকবাজার, চান্দগাঁও, পতেঙ্গা, আগ্রাবাদ, পাথরঘাটা, লালখানবাজার, আন্দরকিল্লা, কাট্টলী, দেওয়ানহাট, ২ নম্বর গেট, মুরাদপুর, চন্দনপুরা ও মোহাম্মদপুর। এর মধ্যে বন্দর, কোতোয়ালি, কেপিজেড, হালিশহর ও সদরঘাট এলাকাকে অতিঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের ওপর সর্বোচ্চ জোর দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে। পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করা, পানি, ময়লা-আবর্জনা যেন জমে না থাকে, নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে ৩ হাজার ৭৬২ জন এবং চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৭২ জন। এর মধ্যে চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর তথ্য না থাকলেও ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২০ জন। এর মধ্যে ৩ জন শিশু, ১১ জন পুরুষ এবং ৬ নারী রয়েছে। ডেঙ্গুতে নগরে ২ হাজার ২২ জন এবং জেলার ১৫টি উপজেলায় আক্রান্ত হন ১ হাজার ৭৪০ জন। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ২৭০ জন, পুরুষ ১ হাজার ৯৩৭ জন এবং নারী ১ হাজার ৪৬৫ জন। অপরদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ৬৬৮ জন, পুরুষ ১ হাজার ৯৭০ জন ও নারী ১ হাজার ১২৪ জন। এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন অনেক লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হার কিছুটা কমেছে। কিছু কিছু এলাকায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের হার বেশি।

ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া দুইটি মশাবাহিত রোগ। এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে অবশ্যই মশা নিধন করতে হবে। মশা নিধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মশা মারতে না পারলে আক্রান্তের হার আরও বাড়বে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ এস এম লুৎফুল কবির শিমুল জানান, বিগত কয়েক মাস ধরে লক্ষ্যণীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে নগরবাসীকে রক্ষায় মশা মারার বিকল্প নেই। শিশু ও বয়স্কের দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। কারণ, শিশুদের ডেঙ্গু হলে তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শরীর কাঁবু করে ফেলে। জেলা কীটতত্ত্ববিদ মো. মঈন উদ্দীন বলেন, হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত এলাকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে পানি জমে থাকার প্রমাণ পেয়েছি আমরা। অথচ জমে থাকা স্বচ্ছ পানি এডিস মশার প্রজননের উপযুক্ত ক্ষেত্র। অনেক এলাকায় আবার ময়লা-আবর্জনাও পড়ে থাকে দিনের পর দিন। কোন মশা কী ওষুধে মরবে, তা নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় ওষুধ ছিটাতে হবে। তবে সিটি কর্পোরেশনকে সব বিষয় জানানো হলেও সমাধানে নেওয়া হচ্ছে না কার্যকর পদক্ষেপ।

স্বাস্থ্য বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন লোক দেখানো কাজ করছে। তাদের ব্যবহার করা কীটনাশকও অকার্যকর। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে লার্ভার ঘনত্বও। গত বছর নগরে লার্ভার ঘনত্ব ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ, এ বছর সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশে। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার (২০ শতাংশ) চেয়ে চার গুণের বেশি। নগরীর হামজারবাগ এলাকার বাসিন্দা মো. লিয়াকত আলী বলেন, ইদানীং মশার উপদ্রব বেশ বেড়েছে। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘরে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় বেশ বিপাকে পড়তে হচ্ছে আমাদের। সিটি কর্পোরেশন বেশ কয়েকবার মশার ওষুধ ছিটালেও মশার উপদ্রব তেমন কমেনি। সিটি কর্পোরেশনের সপ্তাহে আরও বেশি করে মশানিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী জানান, সারাবছর স্প্রে ও ফগিং কার্যক্রম চলে। যেখানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি সেখানে বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম চালানো হচ্ছে। ওষুধ ছিটানোর জন্য ২১০ জন কর্মী আছেন। তারা নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে কাজ করছেন। এর মধ্যে বড় ওয়ার্ডগুলোতে ৭ জন এবং ছোট ওয়ার্ডগুলোতে ৫ জন লোক ওষুধ ছিটানোর জন্য কর্মরত আছেন। এর বাইরে ৭২ জন সদস্য নিয়ে ছয়টি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমগুলো ডেঙ্গু রোগী যেখানে শনাক্ত হচ্ছে সেসব এলাকায় নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের নির্দেশে নগরজুড়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে বিশেষ সমন্বিত ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে শনিবার (১৫ নভেম্বর) চসিকের ১৮ নং ওয়ার্ডের কালা মিয়া বাজার ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক মশক নিধন, লার্ভা ধ্বংস, বর্জ্য অপসারণ ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হয়। চসিক কর্তৃপক্ষ জানায়, বছরের এই সময় ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ায় নগরীর ২৫টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করে সেখানে সক্রিয় মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পৃথক দল মাঠে কাজ করেছে। তারা শুধু প্রাপ্তবয়স্ক মশা ধ্বংসই নয়, বাসাবাড়ি, ড্রেন, নালা, দোকানপাট ও বাজার এলাকার জমে থাকা পানিতে থাকা লার্ভা নিধন ও অবরুদ্ধ পানি অপসারণ কার্যক্রমও পরিচালনা করছেন। এ ছাড়া জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে চসিকের পক্ষ থেকে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, ব্যক্তিগত সতর্কবার্তা প্রদানসহ এলাকায় এলাকায় বিশেষ নির্দেশনা প্রচার করা হচ্ছে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। যেখানে অনিয়ন্ত্রিত পানি জমে থাকা, পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন রাখা, বাসাবাড়ির ছাদে পানি সংরক্ষণসহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। চসিক কর্মকর্তারা জানান, এই ক্রাশ প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য- মশক ঘনত্ব কমানো, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা, নগরবাসীকে পরিচ্ছন্নতার অভ্যাসে সম্পৃক্ত করা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বর্ষা মৌসুমে বাজার এলাকাসহ বিভিন্ন গলিতে পানি জমে থাকায় মশার উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিল। চসিকের এই ক্রাশ প্রোগ্রাম চালুর ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। ভবিষ্যতেও চসিকের নির্দেশনা মেনে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেন তারা। এ ছাড়া আইইডিসিআরের সর্বশেষ পরিচালিত এক গবেষণায় মশার অস্তিত্ব বহুগুণ বাড়ার প্রমাণও মিলেছে। এতে সর্বোচ্চ মশার অস্তিত্ব মিলেছে নগরের আগ্রাবাদে, ১৩৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।