ইসলাম কায়েম হলে দেশে চাঁদাবাজি-অবিচার থাকবে না

বরিশালে আট ইসলামি দলের বিশাল সমাবেশ

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বরিশাল ব্যুরো

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, ৫৩ বছর ধরে দেশের মানুষ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার চেয়েও পায়নি। আমরা ৫৩ বছর দেখেছি, বিএনপি দেখেছি, আওয়ামী লীগ দেখেছি, জাতীয় পার্টি দেখেছি, কিন্তু ইসলাম আমরা দেখি নাই। দেশের মানুষের কাছে একবারের জন্য ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার সুযোগ চাই। ইসলাম কায়েম হলে দেশে আর মায়ের কোল খালি হবে না, চাঁদাবাজি ও অবিচার থাকবে না। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বরিশালের বেলস পার্ক মাঠে পাঁচ দফা দাবিতে আট দল আয়োজিত বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি বিগত সরকারের দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

চরমোনাই পীর বলেন, আজকে এই সমাবেশ প্রমাণ করেছে দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে বরিশালের মাটি ইসলামের ঘাঁটি। ৫৩ বছর মানুষ চেয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা- ৫৩ বছর আমরা না পাওয়ায় আজকে সমাবেশের মাধ্যমে তা আলোর মুখ দেখার বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।

ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, যারা ক্ষমতা প্রেমিক রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময় মুখরোচক কথার মাধ্যমে আমাদের বাংলাদেশের মানুষকে বারবার বোকা পেয়ে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পরে বারবার ওই ক্ষমতার চেয়ারে বসে আমাদের হাজার হাজার মায়ের কোলকে সন্তানহারা করেছেন। আমাদের দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এই দেশকে বারবার চোরের দিক থেকে তামাম দুনিয়ার মধ্যে ফার্স্ট বানিয়েছে। আজকের সমাবেশ থেকে সেই খুনিদেরকে, সেই চাঁদাবাজদেরকে, সেই টাকা পাচারকারীদেরকে- যারা বিদেশের তাঁবেদারি করে আমাদেরকে গোলামির জিঞ্জিরায় আবদ্ধ করে রেখেছিল, তাদেরকে মেসেজ দিতে চাই যে, আর খুনিদের জায়গা, চাঁদাবাজদের জায়গা আর বিদেশে টাকা পাচারকারীদের জায়গা বাংলার জমিনের মধ্যে হবে না। তাদের উৎখাত করতে হবে, মানবতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মুফতি রেজাউল করীম বলেন, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে যারা জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, চক্ষু হারিয়েছে, এখনো মায়ের কান্না বন্ধ হয় নাই। এরপরেও যারা নাকি ক্ষমতা প্রেমিকরা, যারা আমাদের বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে যারা চাঁদাবাজি শুরু করে দিয়েছেন, বিদেশি তাঁবেদারদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যারা আমাদের দেশকে অসুস্থ ও অশান্ত করার প্রক্রিয়া করেছেন- দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে চাই, আজকে তাদের জায়গা বাংলার জমিনের মধ্যে হবে না। তিনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বড় আশা করে আমরা গণঅভ্যুত্থানে জানের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম, কিন্তু এই চাঁদাবাজ দেখার জন্য আমরা রাস্তায় নামি নাই। মানুষ খুন হবে, এর জন্য আমরা রাস্তায় নামি নাই। আমাদের দেশের ভেতরে আবার অশান্তি তৈরি হবে, এই জন্য আমরা রাস্তায় জীবন দেওয়ার জন্য নামি নাই।

চরমোনাই পীর বলেন, সারা বাংলাদেশে আমি সফর করার পরে দেখেছি আপনাদের পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। এখনো যদি আপনারা না বুঝেন তাইলে আপনাদেরকেও সেই ইতিহাস গুনতে হবে। যে ইতিহাসের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বলেছিল যে, শেখ হাসিনা পালায় না। কিন্তু ভাত পাক করেও খেয়েও যেতে পারে নাই। আপনারাও আজকে যদি জনগণের অবস্থা না বুঝেন, নির্বাচন নিয়ে যদি আপনারা টালবাহানা করেন- আপনাদেরকেও ইতিহাস সাক্ষী থাকবে, বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের সেভাবে বাংলার জমিন থেকে উৎখাত করবে।’

তিনি বলেন, ৫৩ বছরে দেখেছি, আর নয়। বারবার ঘোমটা বেঁধে টুপি মাথায় রেখে ইসলামের পক্ষে সুন্দর সুন্দর কথা বলে বারবার আমাদেরকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার পরে ইসলামকে সর্বক্ষেত্রে জবাই করার প্রবণতা আমরা বাংলাদেশে আপনাদের থেকে দেখেছি। বারবার দেশের উন্নয়নের কথা বলে, মানবতার কল্যাণের কথা বলে আপনারা বারবার মানবতাকে জবাই করেছেন। দেশের উন্নয়ন না করে বিদেশে বেগমপাড়া তৈরি করেছেন। সমাবেশ শেষে মুফতি রেজাউল করীম বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ জামায়াত নেতা ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং অন্যান্য অসুস্থ ব্যক্তিদের সুস্থতা কামনা করে দোয়া করেন। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াসহ জামায়াতের আব্দুল্লাহ তাহের ভাইসহ অনেকেই অসুস্থ, দোয়া চেয়েছি আল্লাহ সবাইকে সুস্থ করুক।

মানুষের রচিত মতবাদ বাংলাদেশে রাখতে চাই না- মুজিবুর রহমান : জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেছেন, আমরা মানুষের রচিত মতবাদ বাংলাদেশে রাখতে চাই না। আমরা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সংবিধান তৈরি করতে চাই। ইসলামের সাথে সংঘর্ষপূর্ণ বিধানগুলোকে বাতিল করে মদিনার সনদের আলোকে, কুরআনের সংবিধান অনুযায়ী দেশ চালাতে চাই। মঙ্গলবার বরিশালের বেলস পার্ক মাঠে পাঁচ দফা দাবিতে আট দল আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, আল্লাহ তায়ালা সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ এবং ৪৭-এই তিনটি আয়াতে বলেছেন, যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র বা বিচারকার্য পরিচালনা করে না, তারা কাফের, তারা জালেম, তারা ফাসেক। এই অপবাদ যাতে আমাদের ঘাড়ে না আসে, তাই বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে বলব- আসেন আমরা বাংলাদেশকে মানুষের আইন দিয়ে নয়, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান কুরআনের আইন দিয়ে চালাই।

তিনি বলেন, বিগত ৫৪ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে কুরআন মাজিদের একটা আইনও জাতীয় সংসদে পাস হয় নাই। ৫৪ বছরে বিগত দলগুলো আল্লাহর আইন চালু করার কোনো ভূমিকা রাখে নাই। এ দল দেখাও শেষ, ওই দল দেখাও শেষ। আগামী দিন ইসলামের বাংলাদেশ। জুলাই বিপ্লব ও বিগত সরকারের বিচার প্রসঙ্গে এই জামায়াত নেতা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বিগত সরকার মানুষ হত্যা করেছে, খুন করেছে, গুম করেছে। তাদের বিচার শুরু হয়েছে। কেউ যদি বলে আমরা ক্ষমতায় গেলে এসব মামলা তুলে নেব, তাহলে তা হবে জুলাই বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। যারা অন্যায় করেছে এবং যারা অন্যায়কে সাহায্য করেছে- তাদের বিচার হতে হবে। কারণ অন্যায়কারী এবং সাহায্যকারী উভয়ের অপরাধ সমান।

আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে যারা অতীতে অন্যায় কাজ করেছে, তাদের অংশগ্রহণ করা মোটেই উচিত না। ইতোমধ্যে একটি দলের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন তাদেরকে যারা সাহায্য করেছিল, তাদেরও একই শাস্তি হওয়া উচিত। সমাবেশে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, আমরা দুনিয়ার জীবনে বেশি দিনের জন্য আসি নাই। আল্লাহর কাছে যখন ফিরে যাব, তখন যদি জিজ্ঞাস করা হয়- তোমার জীবন বিধান কী ছিল? আমরা সবাই বলব ইসলাম। তাই আসুন, সকল ইসলামি দল ও প্রতিষ্ঠান ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে কুরআনের আইন চালু করি। আমরা এই জোট ও সমাবেশকে সফল করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব ইনশাআল্লাহ।

চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে অনেকের কাছে শুনে মনে করতাম যে পীর মানে এর ভিতরে ভেজাল আছে, বেদাত আছে, বিভিন্ন ধরনের চিন্তা আছে। কিন্তু আজকে পীর সাহেবের পাশে বসে তার কথা, তার আচরণ আমার কাছে মনে হয়েছে—বাংলাদেশের ইনি পীর নয়, বাংলাদেশের ইসলাম কায়েম করার জন্য এক মহা বীর। আমি দোয়া করি আল্লাহ তাআলা তাকে ইসলাম কায়েমের একজন মস্ত বড় বীর হিসাবে বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত কোরআন এবং সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠার এই বিজয়কে যেন ত্বরান্বিত করতে পারেন।

সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির নেতারা বক্তব্য দেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।