স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পাশে দাঁড়িয়ে তার পদত্যাগ চাইলেন সাদিক কায়েম

* স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে শাহবাগ অবরোধ * ‘হাদির ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলার পর দায়িত্বে থাকার অধিকার নেই সিইসির’ * ‘প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে হাসিনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি’

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়েই তার পদত্যাগ দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি সাদিক কায়েম। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সাদিক কায়েমের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে তিন দফা দাবি তুলে ধরে। তিন দফা দাবি তুলে ধরে সাদিক কায়েম বলেন, এসব দাবি অনতিবিলম্বে না মানা হলে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখাতে না পারলে স্বরাষ্ট্র, আইন ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে। এসময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তার পাশেই ছিলেন। ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম বলেন, ‘দাবি ১: আমাদের ভাই ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের সঙ্গে জড়িত প্রত্যক্ষ হামলাকারী, পরিকল্পনাকারী ও সহায়তাকারী সব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্রের সব সংশ্লিষ্ট অর্গানকে দ্রুত জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং যাদের গাফিলতি প্রমাণ হবে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। একই সঙ্গে যারা এই হামলাকে সমর্থন যুগিয়েছে, হাদি ভাই ও জুলাই বিপ্লবীদের হত্যাযোগ্য করে তুলেছে, সেই কালচারাল ফ্যাসিস্টদের সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ বয়কট করতে হবে। এসব ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে দৃশ্যমান করতে হবে।’ ‘দাবি ২: আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিষিদ্ধ লীগের বিরুদ্ধে এলাকাভিত্তিক চিরুনি অভিযান শুরু করতে হবে। নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের সব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে হবে এবং সব ধরনের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের অবহেলা আমরা আর সহ্য করবো না।’ ‘দাবি ৩: ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম ও অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে খুনি হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রদত্ত রায় কার্যকর করতে হবে। গণহত্যাকারী সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রতিবাদে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে হবে। অভিযুক্তদের ফেরত না দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যাবে না।’ এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। হাদিকে গুলি করা ঘাতক ভারতে পালিয়ে গেলো কীভাবে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা পরে কথা বলবো।’ আসামিরা দেশে আছে, নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছে, বিষয়টি মানুষ এখন জানতে চাচ্ছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সবকিছু তো এখানে বলা যাবে না।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের প্রতিটি দাবি যৌক্তিক। এই দাবিগুলো গতকাল মিটিংয়েও আমরা বলেছি, এগুলো বেগবান করতে হবে। এই যৌক্তিক দাবিগুলো অবশ্যই অবশ্যই বাস্তবায়ন করবো।’ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘ওসমান হাদি অসুস্থ, আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন। তিনি যেন আবার সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসতে পারেন।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে শাহবাগ অবরোধ : ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে এনসিপির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রশক্তি। গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। অবরোধে ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘হাদির ওপর গুলি কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘ এক-দুই-তিন-চার, জাহাঙ্গীর তুই গদি ছাড়’সহ নানা স্লোগান দেন ছাত্রশক্তির নেতাকর্মীরা। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘আমরা আজকে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন কর্মসূচি পালন করব। আমাদের আন্দোলন জনদুর্ভোগ তৈরি করার জন্য নয়। আমাদের কর্মসূচি জনমত ও ন্যায়ের কর্মসূচি। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে যাতে জনদুর্ভোগ কম হয়।’ শাহবাগ থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, শাহবাগ মোড় আটকে দিয়ে তারা স্লোগান দেন। পুলিশ তাদেরকে বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

হাদিকে গুলি ‘ইন্টেলিজেন্স ফেইলিয়র’, সরকারকে জবাব দিতে হবে- পরওয়ার : ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে সোমবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বদলীয় প্রতিরোধ সমাবেশে অংশ নিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ইনকিলাব মঞ্চের নেতা ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় ‘ইন্টেলিজেন্স ফেইলিয়র’। এই ব্যর্থতার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।

মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, হাদির ওপর আক্রমণের আগে থেকেই সে বলছিল, ‘আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি’। কথাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ইন্টেলিজেন্সের সবাই জানার পরও তার নিরাপত্তায় গোয়েন্দা সংস্থা কী ব্যবস্থা নিয়েছে? এই ইন্টেলিজেন্স ফেইলিয়রের জন্য সরকারকে জবাব দিতে হবে। তিনি বলেন, হাদির ওপর হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা একটা প্যাকেজ প্রোগ্রাম। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে গতকাল (রোববার) বলেছি—ডিজিএফআই, ডিবি, এসবি, এনএসআই হাজার হাজার কোটি টাকা বেতন নেয়। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আপনারা জনগণের নিরাপত্তায় একটি গোয়েন্দা তথ্য দিয়েও সহায়তা করতে পারেননি। প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে এই জামায়াত নেতা বলেন, আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটলো। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা ছিলাম তাদের ওপর আক্রমণ হলো। আপনি বারবার জাতীয় ঐক্য অটুট রাখতে বলেন, সেটা তো আমরা করছি। আমরা ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু আপনার সরকার ফ্যাসিবাদের অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের সমালোচনা করে গোলাম পরওয়ার বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি শেখ হাসিনাকে যারা আশ্রয় দিয়েছে, হাদির ওপর গুলি করা ব্যক্তিকে যারা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে দেবে না। কিন্তু নির্বাচন বানচাল করে এদেশকে ভারতের কলোনি বানাতে দিতে আমরা রাজি নই। তিনি বলেন, টকশোতে সুশীলরা, বুদ্ধিজীবীরা করপোরেট হাউজে বসে যে ন্যারেটিভ হাদির দিকে টার্গেট করলেন, সেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজকের এ জনসভা। আজ গোটা জাতি প্রতিরোধের আওয়াজ তুলেছে।

হাদির ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলার পর দায়িত্বে থাকার অধিকার নেই সিইসির : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করার পর নৈতিকভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) আর তার পদে থাকার অধিকার রাখেন না। তিনি বলেন, শরিফ উসমান হাদি ভাইয়ের ওপর হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যে ইলেকশন কমিশন এ কথা বলে সেই ইলেকশন কমিশনারের দায়িত্বে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার থাকে না। গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ওসমান হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে সর্বদলীয় প্রতিরোধ সমাবেশে এ কথা বলেন তিনি। নাহিদ বলেন, আগামীকাল (মঙ্গলবার) বিজয় দিবসে আমরা ঢাকা শহরে প্রতিরোধের র‍্যালি করব। আমরা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর ঐক্যবদ্ধ হব। ভারতকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ভারত যদি মনে করে- বাংলাদেশকে ৫ আগস্টের পরেও আগের মতোই রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করবে, নির্বাচনে কারচুপি করবে। আমরা ভারতের সেই ভাবনা ভুল প্রমাণ করবো। তিনি বলেন, আশা করি নির্বাচন কমিশনার তার বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন। আমরা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ চাই, তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে তা সম্ভব হবে মনে হচ্ছে না। ফলে আমরা চাই, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ বজায় থাকবে এবং গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি যারা জুলাই বিপ্লবকে টার্গেট করছে— মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ও আইনাঙ্গনে মুজিববাদী রাজনীতি পুনরায় শুরু করতে যাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আমাদের গণপ্রতিরোধ চলবে।

প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে শেখ হাসিনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি- ছাত্র অধিকার পরিষদ : বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমুল হাসান বলেছেন, বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের মধ্যে আমরা শেখ হাসিনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। শেখ হাসিনা যেমন করে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করে খুন করে পরের দিন তার স্ত্রী কন্যাকে গণভবনে নিয়ে তার পরশমাখা স্নেহ দিয়ে বোঝাতেন, ঠিক তেমনিভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রধান উপদেষ্টা ওসমান হাদির পরিবারের লোকজনকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। আমরা তো এই সান্ত¡না চাই না, এদেশের মানুষ সেই সান্ত¡না চায় না। সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। নাজমুল বলেন, আমার ভাইয়েরা আইসিইউতে থাকবে, নিশ্বাস নিতে পারবে না। আর আপনি যমুনায় বসে আরাম আয়েশ করবেন সেটি আমরা মেনে নিতে পারবো না। তিনি আরও বলেন, এরকম পরিবেশ যদি থাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের লাশের নির্বাচন উপহার দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে যেখানে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম নিরাপত্তা নাই,সেখানে বৃহৎ কর্মযজ্ঞের জাতীয় নির্বাচন করার সুযোগ নাই। প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যদি আপনি না বোঝেন তাহলে পুঞ্জিভূত রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হবে যমুনাতেও। আপনি যদি স্বরাষ্ট্র উপদেশটাকে অব্যাহতি না দেন আমরা ছাত্র-জনতা যমুনা ঘেরাও করব। এ সময় নাজমুল হাসান তাদের ৫ দাবি তুলে ধরেন: দাবিগুলো হচ্ছে- ১. স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদাবক্সের পদত্যাগের দাবি। ২. আওয়ামীলীগের দোসর জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনোভাবেই তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া যাবে না। ৩. সীমান্ত বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওসমান হাদির শুটার ফয়সাল ও মাসুদকে ফেরত না দিলে ভারতীয় দূতাবাস বন্ধের হুশিয়ারি। ৪. আওয়ামী লীগের কেউ যেনো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচন করতে পারে, তার জন্য ইসিকে কঠোর হতে হবে এবং ৫. ৩১ আগস্ট ভিপি নুরের ওপর হামলায় জড়িত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বিচারের দাবি।