থেমে গেল দ্রোহের কণ্ঠস্বর

শোকে স্তব্ধ দেশ, সারা দেশে বিক্ষোভ, আজ আসবে মরদেহ

প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদি মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে (এসজিএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এনসিপির স্বাস্থ্য সেলের প্রধান ও হাদির চিকিৎসায় নিয়োজিত মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য ডা. আহাদ ভিডিও বার্তায় বিষয়টি নিশ্চিত করেন। একইসঙ্গে সিঙ্গাপুরে ওসমান হাদির চিকিৎসা দেখভালের সঙ্গে যুক্ত থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ওসমান হাদির মৃত্যুর তথ্য জানান। হাদির মৃত্যুর সংবাদ শুনে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে জড়ে হতে থাকেন ছাত্র-জনতা। উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ।

ভারতীয় আধিপত্যবাদের মোকাবিলা, জুলাই অভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পাওয়া ওসমান হাদি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ আগে ভোটের প্রচারে গিয়ে ঢাকার বিজয়নগর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। চলন্ত রিকশায় থাকা হাদিকে গুলি করেন মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এক নেতা। ওই আসামি ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে আলোচনা রয়েছে। পরে গুরুতর আহত হাদিকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করার পর রাতেই তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সোমবার দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যু হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকালে ইনকিলাব মঞ্চের ফেইসবুক পেইজে বলা হয়, ওসমান হাদি ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ আছেন। সিঙ্গাপুরেই তার অস্ত্রোপচার করতে পরিবারের পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গতকাল রাতে হাদির মৃত্যুসংবাদ এল।

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ভেরিফায়েড পেজে এ তথ্য নিশ্চিত করে লিখেছেন, ‘আমাদের ভাই হাদী রওনা দিয়েছেন অনন্তের পথে। আবরার, আবু সাঈদদের মতো হাদি না থেকেও আরো বেশি করে থাকবেন বাংলাদেশের বুকে।’ অপর এক ফেসবুক পোস্টে সাবেক ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া লিখেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অগ্রসৈনিক, আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের সংগ্রামী নেতা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদী ভাই শাহাদাৎ বরণ করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে আমার ভাইয়ের শহীদি আত্মদান মজলুম এ জনগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রামে এক অনন্ত প্রেরণার নাম হয়ে থাকবে। জান দেবো, তবু জুলাই দেব না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ! এর আগে সিঙ্গাপুরে জরুরি অস্ত্রোপচারের অনুমতি দেয় হাদির পরিবার। ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেইজে বলা হয়, ওসমান হাদী যদি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে শহীদের কাতারে শামিল হয়, সেক্ষেত্রে পুরো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মজলুম জনতাকে সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণে শাহবাগে জড়ো হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। ইনকিলাব মঞ্চ বলছে, ‘খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আমরা শাহবাগে অবস্থান করব এবং পুরো বাংলাদেশকে অচল করে দেওয়া হবে। খুনি যদি ভারতে পালিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে যে কোনো মূল্যে তাকে গ্রেপ্তারপূর্বক ফেরত আনতে হবে।

উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা : উপদেষ্টা পরিষদের হাদির স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। উপদেষ্টা পরিষদে জানানো হয়, সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণানের সঙ্গে নিয়মিত প্রধান উপদেষ্টা যোগাযোগ এবং খোঁজখবর রেখেছিলেন।

তিন হাত বদলে অস্ত্র যায় নরসিংদীতে : হাদিকে গুলি করার পর প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সাল করিমের অস্ত্র লুকানো ও সরানোর বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকার আগারগাঁও থেকে শুরু হয়ে নরসিংদী পর্যন্ত- বাবা, শ্যালক ও বন্ধুর হাত ঘুরে পিস্তল ও গুলি সরানো হয়। এই চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে অস্ত্রের গতিপথ এবং হামলার প্রস্তুতি সম্পর্কে আরও তথ্য মিলছে। তদন্ত- সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির পর দুটি কালো ব্যাগে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও গুলি আগারগাঁওয়ে বোনের বাসায় রেখে পালিয়ে যান ফয়সাল করিম মাসুদ ও তার সহযোগী আলমগীর শেখ। পরে দুটি পিস্তল, গুলিসহ একটি ব্যাগ ফয়সালের স্ত্রীর বড় ভাই ওয়াহিদ আহমেদ ওরফে সিপুর কাছে পৌঁছে দেন ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবির। অস্ত্র, গুলিসহ ওই ব্যাগ সিপু নিয়ে যান নরসিংদী।

গ্রেপ্তার ও আটক ১৪ জন : হাদির ওপর হামলার ঘটনায় র‍্যাব ও পুলিশ এখন পর্যন্ত ১৪ ব্যক্তিকে আটক ও গ্রেপ্তার করেছে। অস্ত্র, গুলিসহ ফয়সালের স্ত্রীর বড় ভাই ওয়াহিদ আহমেদ সিপুর বন্ধু মো. ফয়সাল নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় আটক ও গ্রেপ্তার করা হয় আরও ১৩ জনকে। ফয়সালের বাবা- মা ছাড়া বাকিরা হলেন মো. নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল, মো. কবির, আব্দুল হান্নান, মো. হিরন, মো. রাজ্জাক, ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভিন সামিয়া, সামিয়ার বড় ভাই ওয়াহিদ আহমেদ সিপু, ফয়সলের বান্ধবী মারিয়া আক্তার এবং হালুয়াঘাট সীমান্তে মানব পাচারকারী হিসেবে পরিচিত সিমিরন দিও ও সঞ্জয় চিসিম। এদের মধ্যে ফয়সালকে পালাতে সহায়তার অভিযোগে নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ফয়সলকে গাড়ি ভাড়া করে দেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া আটক উবারচালক হিরন ও রাজ্জাককে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে।

হামলাকারীদের সহযোগী সিবিয়ন ও সঞ্জয় তিন দিনের রিমান্ডে : শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের পালাতে সহযোগিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার দুজনের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলাম শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে তিনি রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আসামিদের পুলিশকে ঘটনা তদন্তে সহযোগিতা করার নির্দেশ দেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্টন থানার করা মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি হলেন সিবিয়ন দিউ (৩২) ও সঞ্জয় চিসিম (২২)। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) মতিঝিল আঞ্চলিক টিমের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ। পুলিশের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক তদন্ত ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রেপ্তার এই দুই আসামি ঘটনার পর মূল অভিযুক্ত ও অজ্ঞাতপরিচয় সহযোগীদের অবৈধভাবে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সরাসরি সহায়তা করেন। তাদের যোগাযোগ, চলাচল এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সংযোগের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সিবিয়ন দিউ হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ও অবৈধ মালামাল পারাপারের একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি ওই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য জুয়েল আড়েংয়ের ভাগনে। মামলার তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, পরিকল্পনাকারীদের নির্দেশনা ও পরামর্শে গ্রেপ্তার দুজন হামলাকারীদের সীমান্ত পারাপারের ব্যবস্থা করেন। এ কারণে ঘটনার মূল রহস্য উদ্?ঘাটন, পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার এবং হত্যাচেষ্টার পেছনের অর্থদাতা ও মদতদাতাদের শনাক্ত করতে তাদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। গত ১২ ডিসেম্বর গণসংযোগের জন্য বিজয়নগর এলাকায় গেলে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। গুলিটি তার মাথায় লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে গত ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। গতকাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে (এসজিএইচ) মারা যান শরিফ ওসমান হাদি।