চিরনিদ্রায় বিপ্লবের রাজপুত্র
ওসমান হাদির দাফন
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহিদ শরিফ ওসমান হাদি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে বিপ্লবের রাজপুত্র ওসমান হাদির দাফন সম্পন্ন হয়।
শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় কয়েক লাখ মানুষের অংশগ্রহণে শহীদ ওসমান হাদির নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। ওসমান হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিকের ইমামতিতে জানাজা আদায় করা হয়। জানাজা শেষে তাকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা, শ্রেণি-পেশার কয়েক লাখ মানুষ জানাজায় অংশ নিয়ে শহীদ হাদির আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। হাদির জানাজার নামাজ পড়ান তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। এসময় পুরো এলাকায় শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এর আগে জানাজায় বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা। ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বক্তব্য দেন এবং শহীদ হাদির জীবনপঞ্জি পাঠ করে শোনান। আরও বক্তব্য রাখেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল জাবের। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া এভিনিউ জুড়ে আবেগ ও প্রতিবাদের মিশ্র চিত্র দেখা গেছে। কেউ হাদির মৃত্যুতে অশ্রুসিক্ত হন, আবার কেউ ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন এবং হাদি হত্যার বিচার দাবি করেন।
কয়েক লাখ মানুষের অংশগ্রহণে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জানাজা শহীদ হাদির : কয়েক লাখ মানুষের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় শহীদ শরিফ ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানাজায় অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, এটাই স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জানাজা। ৬৫ বছর বয়সী ধানমন্ডির বাসিন্দা ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমার জীবনে অনেক জানাজায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু এত বড় জানাজা দেখিনি। শহীদ হাদি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এ কারণে এত মানুষ জানাজায় অংশ নিয়েছেন। শহীদ হাদির জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য শনিবার সকাল থেকেই হাজার হাজার মানুষের মিছিল ছিল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এসে জড়ো হয়। রাজধানীর সব পথ যেন এসে মিলে যায় এক মোহনায় মিলত হয়েছিল। দুপুর ১টার মধ্যে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজার দুটি বড় মাঠ মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। মানুষের ভিড় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর বিশাল রাজপথ ছাপিয়ে ফার্মগেটের খামারবাড়ি ও আসাদগেট পর্যন্ত চলে যায়। উত্তর দিকে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পর্যন্তও ছিল মানুষের ঢল।
জানাজায় অংশ নেওয়া মিরপুর-১ থেকে আসা মাসুদ রানা বলেন, আমার ৪২ বছরের জীবনে এত বড় জানাজা দেখিনি। আমার ধারণা ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ জানাজায় অংশ নিয়েছেন। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আকিব হাসান বলেন, হাদি ভাইয়ের জানাজায় কত লাখ মানুষ হয়েছে বলতে পারব না। তবে এত মানুষ জীবনেও দেখিনি। সেগুনবাগিচার বাসিন্দা সালাউদ্দিন বলেন, আমার ধারণা জানাজায় ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ হয়েছে।
হাদিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, হয়ে উঠলেন সার্বভৌমত্বের বড় প্রতীক- ধর্ম উপদেষ্টা : ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, তারা ওসমান হাদিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল; আর তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে বড় প্রতীকে। সংসদ ভবন এলাকায় শরিফ ওসমান হাদির জানাজার আগে বক্তব্যে ধর্ম উপদেষ্টা এ কথা বলেন। তিনি বলেন, দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে শাহাদতের মর্যাদা দান করেন এবং তার জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি আল্লাহ তায়ালা মার্জনা করেন। আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতুল ফেরদৌসের টুকরা বানিয়ে দেন। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন- আধিপত্যবিরোধী একটি ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন- তার সেই স্বপ্ন পূর্ণতা দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে তৌফিক দান করুন। উপদেষ্টা বলেন, সারাদেশ আজ কাঁদছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় গ্রামগঞ্জে, শহর-বন্দরে সব মসজিদে আমাদের ভাই শরিফ ওসমান হাদির জন্য দোয়া, খতমে কোরআন ও জিকির আজকার সম্পন্ন হয়েছে।
জীবদ্দশায় এত বড় জানাজার নামাজ আর কখনও দেখিনি : ওসমান হাদির জানাজার নামাজে দূর দূরান্ত থেকে অংশ নিতে আসা অনেক ছাত্র জনতা বলেছেন, ‘জীবদ্দশায় এত বড় জানাজার নামাজ আর কখনও দেখেনি।’ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ও মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় কয়েক লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। সরেজমিনে দেখা যায়, জানাজার নামাজ আদায় করার আগেই অনেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে হাদির জন্য দোয়া করেন। কেউ কেউ ‘তুমি কে, আমি কে? হাদি, হাদি; আমরা সবাই হাদি হবো’, ‘বিচার বিচার বিচার চাই, হাদি হত্যার বিচার চাই’-এমন স্লোগান দেন।
জানাজার নামাজ পড়তে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার জীবদ্দশায় এত বড় জানাজার নামাজ আর কখনও দেখেনি। তবে ভাগ্য খারাপ শেষ বারের মতো হাদি ভাইকে একবার চোখের দেখা দেখতে পারিনি।’ এই শিক্ষার্থীর সুরে জানাজার নামাজে অংশ নেওয়া আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী একই কথা বলেন। তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিবুল রানা। তিনি বলেন, ‘শুনেছি জিয়াউর রহমানের জানাজার নামাজেও অনেক লোক হয়েছে। কিন্তু সে সময় তো আমার জন্ম হয়নি। আমার জীবদ্দশায় দেখা সবচেয়ে বড় জানাজার নামাজ এটি। দোয়া করি আল্লাহ যেন হাদী ভাইকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন।’
ওসমান হাদির কবরের দিকে জনস্রোত, শাহবাগে পুলিশের ব্যারিকেড : শরিফ ওসমান হাদির কবরের দিকে জনস্রোত নামে। তবে তা ঠেকাতে রাজধানীর শাহবাগ থানার সামনে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। ফলে লোকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদণ্ডসংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি এলাকায় হাদির কবরে যেতে পারেনি। গতকাল বিকাল ৪টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো শাহবাগ এলাকায় মানুষের ভিড় ছিল। শাহবাগ মোড় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অভিমুখী সড়ক আটকে রাখে পুলিশ। সেখানে উপস্থিত জনতা ‘এক হাদি লোকান্তরে, লক্ষ হাদি ঘরে ঘরে’, ‘ইনসাফ, ইনসাফ’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। কবরস্থানের আশপাশে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়।
হাদির জানাজা ঘিরে রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তা : শহীদ শরিফ ওসমান হাদির নামাজে জানাজাকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। জানাজা উপলক্ষে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে বডি ওর্ন ক্যামেরা, পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-সহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জাতীয় সংসদ ভবন ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বডি ওর্ন ক্যামেরা ও রায়োর্ট কন্ট্রোল গিয়ারসহ ২০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শহীদ ওসমান হাদির গায়েবানা জানাজা করা হয়।
প্রসঙ্গত, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি গত ১২ ডিসেম্বর গণসংযোগের জন্য রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গেলে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে গুলি করা হয়। গুলিটি তার মাথায় লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে হাদিকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাদির মৃত্যুতে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।
