হাদির সমাধি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশেই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন এই প্রজন্মের বিদ্রোহী কণ্ঠ শহিদ শরিফ ওসমান হাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে ইতিহাসের দুই বিদ্রোহীর পাশাপাশি শায়িত হওয়াটা যেন শক্তির প্রতীকে পরিণত করেছে। গতকাল রোববার সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষ ছুটে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে। শুধু রাজধানী নয়, দেশের দূরদূরান্ত থেকেও আসেন নানা বয়সি মানুষ। কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন, কেউ আবার আকশের দিকে আঙুল তুলে দোয়া করেন, কেউ আবার হাদির সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া ও মোনাজাত করেন। সাধারণ মানুষের চোখেমুখে শুধু বেদনা। তারা বলছেন, হাদি মারা যাওয়ার পর যেভাবে তার কবর পাহারা দেওয়া হচ্ছে, সেই নিরাপত্তা যদি আগেই দেওয়া হত, তাহলে আজ হয়তো হাদি বেঁচে থাকতেন। এ সময় উপস্থিত মানুষ হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানান।

মামলায় দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা সংযোজনের আদেশ : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলাটিতে দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা (হত্যা) সংযোজনের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্দিক আজাদ এ আদেশ দেন। গতকাল রোববার পল্টন থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক রোকনুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত শনিবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ মামলাটিতে ৩০২ ধারা সংযোজন করার জন্য ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলার এজাহারনামীয় পলাতক আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুল দাউদ (৩৭) ও অজ্ঞাতনামা সহযোগী আসামিরা গত ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করা, জনমনে আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি করা, সর্বোপরি আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৬ কে বাধা প্রদান এবং আগ্রহী প্রার্থীদের মনোবলে আঘাত হানার মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এরই অংশ হিসেবে মতিঝিল মসজিদ (ওয়াপদা মসজিদ) হতে জুমার নামাজ শেষে নির্বাচনি প্রচারণা সমাপ্ত করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার পথে গত ১২ ডিসেম্বর অনুমানিক দুপুর ২টা ২০ মিনিটের দিকে শরিফ ওসমান হাদিকে বহনকারী অটোরিকশা পল্টন মডেল থানাধীন বক্স কালভার্ট রোডস্থ ডিআর টাওয়ারের সামনে বিজয়নগর পানির ট্যাংকের অভিমুখী পাকা রাস্তার উপর পৌঁছালে তার (শরিফ ওসমান হাদি) পেছন হতে অনুসরণ করে আসা মোটরসাইকেলে থাকা আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুল দাউদ ও তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামি শরীফ ওসমান হাদিকে চলন্ত অবস্থায় হত্যার উদ্দেশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা গুলি করে পালিয়ে যায়।

এতে আরও বলা হয়, শরিফ ওসমান হাদিকে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। তার অবস্থা আরও আশঙ্কাজনক হলে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে হাদির শারীরিক অবস্থা আরও আশঙ্কাজনক হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। ১৮ ডিসেম্বর তিনি সিঙ্গাপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯ ডিসেম্বর শরিফ ওসমান হাদির লাশ বাংলাদেশে আনা হয়। মামলাটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনা। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে মামলায় দায়েরকৃত ধারার সঙ্গে ৩০২ পেনাল কোড ধারা সংযোজনের আদেশদান প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গত ১৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বাদী হয়ে পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ১২০(বি)/৩২৬/৩০৭/১০৯/৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করলেন জামায়াতের আমির : ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির কবর জিয়ারত করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। গতকাল রোববার ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ফজরের নামাজ আদায়ের পর তিনি ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করেন। গতকাল সকাল ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে জামায়াতের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়। এ সময় শফিকুর রহমানের সঙ্গে জামায়াতের নেতাকর্মীরা ছিলেন। ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনা করেন তারা। জামায়াতের আমিরের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মো. মোবারক হোসাইন, ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম, জিএস এসএম ফারহাদ প্রমুখ।

সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার সিভিয়ন ও সঞ্জয় ফের রিমান্ডে : ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার সিভিয়ন ডিউ ও সঞ্জয় চিসিমকে ফের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গতকাল রোববার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সেফাতুল্লাহ শুনানি শেষে তাদের ৫ দিনের রিমান্ড আদেশ দেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার তাদের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন আদালত।

রিমান্ডপ্রাপ্ত এই দুই আসামি এজাহারনামীয় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল দাউদের (৩৭) ও তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামিকে অবৈধ পথে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করার সাক্ষ্য-প্রমাণ ও প্রযুক্তি সহযোগিতায় তথ্য পাওয়া গেছে বলে রিমান্ড আবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ উল্লেখ করেছেন। আসামি সিভিয়ন ডিউ কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জুয়েল আড়েং-এর ভাগিনা।

হাদি হত্যা তদন্তে জাতিসংঘের সহায়তা নেওয়ার আহ্বান গোলাম পরওয়ারের : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তে অগ্রগতি ও খুনিদের গ্রেপ্তারে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না হওয়ায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর মগবাজারে শহীদ ওসমান হাদির মাগফিরাত কামনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে আয়োজিত দোয়া অনুষ্ঠানে এই প্রশ্ন তোলেন তিনি। গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘ওসমান হাদির খুনের বিচারের ব্যাপারে সরকারের নীরবতা কেন? খুনিদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থায় লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিস্টরা হয়তো সেটাই চেয়েছে।’ খুনিদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটা তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নাহলে জনগণ এটাই বিশ্বাস করবে, সরকার সব জেনেও সেটা মেনে নিচ্ছে। যার জন্যই হোক, সেটা গোয়েন্দা সংস্থার লোক হলেও দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে হবে।’ শহীদ শরিফ ওসমান হাদি যা চাইতেন, সেটা যারা চায় না তারাই তাকে হত্যা করেছে বলেও অভিযোগ করেন জামায়েতের সেক্রেটারি জেনারেল।

খুনের তদন্তে প্রয়োজনে জাতিসংঘের কারিগরি সহায়তা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন কেউ করতে চাইলে জনগণ ছেড়ে দেবে না। যারাই জড়িত তাদের নাম প্রকাশ করুন।’

জামায়াতের মনোনীত সংসদ সদস্যরা নিরাপত্তা শঙ্কায় রয়েছেন জানিয়ে গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাদির ওপর গুলি করাকে বললেন- এটা নাকি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা! তফসিল ঘোষণার পরদিনই একজন সংসদ সদস্য পদ প্রার্থীর হত্যাকাণ্ডের দায় তাকেও নিতে হবে।’ অনুষ্ঠানে হাদির বড়ো ভাই আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা কারও কাছে কোনো অনুদান চাই না। আমরা চাই হাদির সাম্যের বাংলাদেশ, চাই তার হত্যার বিচার।’

আর্থিক সহায়তা বা অনুদান নয়, অসমাপ্ত বিপ্লব সমাপ্ত করতে চাই- ওসমান হাদির ভাই : গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রদূত ওসমান হাদির অসমাপ্ত সংগ্রাম শেষ করার আহ্বান জানিয়েছেন তার মেজো ভাই ওমর বিন হাদি। স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেন, পরিবার কোনো আর্থিক সহায়তা বা অনুদান চায় না; তাদের একমাত্র দাবি, ওসমান যে আদর্শ ও বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য জীবন দিয়েছেন, তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হোক। ওমর বিন হাদি বলেছেন, আমরা কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা বা অনুদান চাই না। তিনি বলেন, ওসমান যে বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য জীবন দিয়েছে, সেই অসমাপ্ত বিপ্লবকে সমাপ্ত করাই তাদের একমাত্র দাবি। গতকাল রোববার সকালে মগবাজারে জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত দোয়া মাহফিলে এ আহ্বান জানান তিনি।

ওমর বিন হাদি বলেন, আমাদের প্রায় সময় ওসমান বলত আমি যদি কখনও রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাই, তাহলে আপনি শহিদের ভাই হবেন। আমার মাকে বলত, আমি যদি চলে যাই তাহলে আপনি শহিদের মা হবেন। এর চেয়ে আর গর্বের কিছু নেই। কিন্তু আমি শহিদের ভাই হতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম রাজপথে বিপ্লবী ওসমানের পাশে থেকে। এই বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদ মুক্ত করতে। আমি চেয়েছিলাম ইনসাফের বাংলাদেশ পর্যন্ত গঠন না হবে, আমরা রাজপথ ছাড়ব না। কিন্তু আজকে ওসমান চলে গেছেন। আল্লাহকে তাকে সর্বোচ্চ পুরস্কার দিয়ে নিয়ে গেছেন।

ওমর বিন হাদি বলেন, শুক্রবার জুমার নামাজের পর গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক সপ্তাহ পর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন ওসমান হাদি। তার শাহাদাতে পরিবার, ইনকিলাব মঞ্চ এবং আন্দোলনের সহযোদ্ধারা গভীরভাবে শোকাহত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমরা এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারিনি। জানি না, আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব কি না।

বক্তব্যে শেষে তিনি ওসমান হাদির আট মাসের সন্তানের জন্য, তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া চান। বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাইকে বড় করার ক্ষেত্রে ছোট বোনের ত্যাগের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া বোনের সুস্থতার জন্যও সবার কাছে দোয়ার আহ্বান জানান।

প্রসঙ্গত, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে ওসমান হাদিকে মাথায় গুলি করে দুর্বৃত্তরা। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে ওসমান হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান। তার মরদেহ গত শুক্রবার সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আনা হয়। রাখা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের মর্গে। গত শনিবার সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আবার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। পরে সেখানে গোসল শেষে মরদেহ জানাজার জন্য সংসদ ভবন এলাকায় নেওয়া হয়। হাদির মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়।

হাদির হত্যাকারী দেশের বাইরে চলে গেছে, এমন তথ্য নেই- পুলিশ : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ দেশের বাইরে চলে গেছেন কি না, এমন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। অনেক সময় অপরাধীদের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত ‘পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির যৌথ সংবাদ সম্মেলনে’ এ কথা বলেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খন্দকার রফিকুল ইসলাম।

শুটার ফয়সাল করিম সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ফয়সালের শেষ অবস্থান নিয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা পেতে আমাদের বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তবে সে যে দেশের বাইরে চলে গেছে, এমন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাইনি। অনেক সময় অপরাধীদের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়।

হত্যাকাণ্ডে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা এখনও স্পেসিফিক কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা পাইনি। তবে আমরা সঠিক তথ্য পেতে চেষ্টা করছি।

ফয়সাল করিম মাসুদের তথ্য সম্পর্কে ডিবিপ্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ফয়সাল করিম মাসুদের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। আপনারা (সাংবাদিক) যেমন শুনতেছেন, আমরাও বিভিন্ন তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে সবগুলো তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনে হচ্ছে ব্যক্তিগত কোনো শুত্রুতা নয়, রাজনৈতিকভাবে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়ে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। ফয়সাল ও আলমগীরকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারিনি, ফলে সেভাবে এখন জানা যায়নি।

ডিবিপ্রধান বলেন, ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাদিকে গুলির পর প্রত্যেক ইউনিটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসামি গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ জনকে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, অস্ত্র, গুলি ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে।

শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ছবি আপলোড করেছিল, সেটি ভারত থেকে আপলোড করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। আপনারা ছবিটি ফরেনসিক করেছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তাধীন বিষয়। সবগুলো বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।

ভিডিও ফুটেজে দেখেছি হাদির পাশে আসামিরা ছিলেন। তারা কার মাধ্যমে এসেছিলেন। অর্থাৎ মাস্টারমাইন্ড কারা। এসব বিষয় আপনারা তদন্ত করেছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, এটি বড় তদন্তাধীন বিষয়। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মামলা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে।

হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরাতে রিট : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার এবং তারা বিদেশে অবস্থান করলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের দেশে ফেরানোর নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি সন্দেহভাজন আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে রিট আবেদনে। মানবাধিকার সংগঠন সারডা সোসাইটির পক্ষে প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মো. মুরাদ ভূঁইয়া জনস্বার্থে গতকাল রোববার এই রিট আবেদন করেন। রিটে বিবাদীরা হলেন- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ডিএমপি কমিশনার ও ইন্টারপোল ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি), বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা। রিটের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মো. মুরাদ ভূঁইয়া নিজেই।

রিটকারী মুরাদ ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, রিট আবেদনে বিভিন্ন বিষয়ে রুল ও নির্দেশনা জারি চাওয়া হয়েছে। জুলাই যোদ্ধা ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার, জড়িতরা বিদেশে অবস্থান করলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতকরণের জন্য এই আবেদন করা হয়েছে।

রিটকারী বলেন, ওসমান হাদিকে হত্যার ঘটনায় জড়িত দুজন মূল অপরাধী বিদেশে অবস্থান করলে, তাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলসহ আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সন্দেহভাজন আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে কেন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হবে না- এই মর্মে বিবাদীদের বিরুদ্ধে রুল ও আদেশ জারি করার জন্য প্রার্থনা করেছি।

রুল জারির পর সেটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের নির্দেশ, সন্দেহভাজন আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার নির্দেশ দিতে আর্জি জানানো হয়েছে রিটে। হাইকোর্টের বিচারপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ সুমন এবং বিচারপতি দিহিদার মাসুম কবীরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে রিটকারী মো. মুরাদ ভূঁইয়া নিজেই চলতি সপ্তাহে শুনানি করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।