৭০ শতাংশ ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আর মাত্র দেড় মাস বাকি। রাজনৈতিক দলসহ সব স্তরে বর্তমান নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে ওসমান হাদি হত্যা এবং ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেইলি স্টার’ কার্যালয়ে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরইমধ্যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে যে রিপোর্ট এসেছে, তাতে আগামী ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়বে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪২ হাজার ৭৬১টি কেন্দ্রের মধ্যে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তফশিল ঘোষণার পর দিন যত যাচ্ছে, এই তালিকার সংখ্যা আরও বাড়ছে।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সূত্র জানায়, মোট ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৮ হাজার ৬৬৩টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, যা মোট কেন্দ্রের ৬৭ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে, কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রায় ৩০ হাজার কেন্দ্র ‘ঝুঁকিপূর্ণ’; সেই হিসেবে এ হার ৭০ শতাংশ।

সূত্রমতে, ভোটার সংখ্যা, থানা থেকে দূরত্ব, রাজনৈতিক আধিপত্য, দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা এবং চরাঞ্চল বিবেচনায় সারা দেশের কেন্দ্রগুলোকে লাল (অতি ঝুঁকিপূর্ণ), হলুদ (ঝুঁকিপূর্ণ) ও সবুজ (সাধারণ) এই তিন ভাগে ভাগ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এবার অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা বেশি, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় এই প্রবণতা প্রবল।

জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত। এর মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল সম্পূর্ণ ‘একতরফা’, যেখানে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়ী হওয়ায় ভোটের প্রয়োজন হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচন দেশজুড়ে ‘রাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

বিগত তিনটি নির্বাচনেই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। আগামী নির্বাচনে পুলিশ যাতে কোনো বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করে, সে জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরইমধ্যে লটারির মাধ্যমে ৬৪ জেলায় পুলিশ সুপার (এসপি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই পদ্ধতিতে দেশের সব থানার ওসি পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশের দেড় লাখ সদস্যকে নির্বাচনের সময় ‘করণীয় ও বর্জনীয়’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে ৬০ হাজারের বেশি সদস্যের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে; বাকিদের প্রশিক্ষণ জানুয়ারি মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এদিকে, দেশব্যাপী নির্বাচনি দায়িত্ব পালনের জন্য ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনাসদস্য মোতায়েনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। তারা ভোটের তিন দিন আগে থেকে শুরু করে ভোটের চার দিন পর পর্যন্ত মোট আট দিন মাঠে থাকবেন। ইসির এক কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে কর্মকর্তা ও নির্বাচনি সরঞ্জাম রক্ষা করতে পারবে। বর্তমানে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চলছে।

অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের নিরাপত্তা : পুলিশের প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে তিনজন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে দুজন এবং সাধারণ কেন্দ্রে একজন করে পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হবে। প্রত্যেকের কাছে অস্ত্র এবং বডি ওর্ন ক্যামেরা থাকবে। এছাড়া প্রতি কেন্দ্রে ১৩ জন করে আনসার সদস্য থাকবেন। পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে।

পুলিশের আশঙ্কা ও চ্যালেঞ্জ : পুলিশ সদর দপ্তরের এক গোপন নথি অনুযায়ী, গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে লুণ্ঠিত সব অস্ত্র ও গুলি এখনও পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের আগে এগুলো উদ্ধার করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া ৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় ঝুঁকি বেড়েছে।

ইতিহাসের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচন : নির্বাচনের সময় স্বার্থান্বেষী মহল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী, চরমপন্থি অধ্যুষিত এবং সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এলাকাগুলোতে আলাদা নিরাপত্তা পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গুজব ও অপপ্রচার রোধে গঠিত হচ্ছে ‘সাইবার মনিটরিং সেল’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি ‘ডিপ ফেইক’ ভিডিও বা মিথ্যা বার্তা রোধে সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বাড়ানো হবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষণ : পুলিশের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থি গ্রুপ এবং পার্বত্য জেলার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে। এছাড়া ১১৩টি আসনে সংখ্যালঘু ভোটার ১০ শতাংশের বেশি হওয়ায় সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বিশেষ নজর দেওয়া হবে।

আইন সবার জন্য সমান -সিইসি : গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ডিসি-এসপিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। অপরাধী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা অতীতের খারাপ নির্বাচনের অপবাদ ঘুচিয়ে দিতে চাই।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘দেশ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এবার আইনের শাসন কাকে বলে, তা আমরা দেখিয়ে দিতে চাই।’