ট্রাম্প-জেলেনস্কির উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা

প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

হোয়াইট হাউসে বিশ্ব মিডিয়ার সামনে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে গত শুক্রবার নাটকীয় বাগবিতণ্ডায় জড়ানোর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক বিপর্যয়ে পরিণত হয়। ওভাল অফিসের এই বৈঠককে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষ না নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন জেলেনস্কি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স উল্টো বলে বসেন, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রকে অসম্মান করেছেন। এর জেরে যুদ্ধকালীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের সঙ্গে কিয়েভের সম্পর্কের আরও অবনতি হলো। একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানান, বৈঠকের একপর্যায়ে জেলেনস্কিকে চলে যেতে বলা হয়। এদিকে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল, তা-ও স্বাক্ষর হয়নি। আশা করা হচ্ছিল, এ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুদেশের সম্পর্কের উন্নতি হবে। এ ঘটনার পর জেলেনস্কির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন ইউরোপের নেতারা। জার্মান চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী ফ্রিডরিখ মের্জ বলেন, ‘এই ভয়ংকর যুদ্ধে আক্রমণকারী আর ভুক্তভোগীকে কখনও গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুট ও ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন জেলেনস্কি। আজ রোববার ব্রিটেন ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করতে যাচ্ছে। সেখানে মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ক্রমেই রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছেন ট্রাম্প, যা ইউরোপ ও অন্যান্য মিত্রদের হতবাক করেছে। আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে ইউক্রেনকে। বৈঠকের উত্তপ্ত পরিবেশ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় সংঘাতের সমাধানে কূটনৈতিক পথের গুরুত্ব তুলে ধরেন। জেলেনস্কি এ সময় পাল্টা মন্তব্য করেন যে, পুতিনকে বিশ্বাস করা যায় না এবং ভ্যান্স কখনো ইউক্রেন সফর করেননি। কোন কূটনীতির কথা বলছেন, জে ডি?’ রাশিয়ার সঙ্গে ব্যর্থ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন করেন জেলেনস্কি। ভ্যান্স পাল্টা জবাব দেন, ‘আমি এমন কূটনীতির কথা বলছি যা আপনার দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবে।’

জেলেনস্কি সরাসরি ট্রাম্পের রুশপন্থী অবস্থানের সমালোচনা করে বলেন, ‘একজন খুনির সঙ্গে আপস করবেন না।’ ট্রাম্পের টিম বলেছে, তিনি ও ভ্যান্স ‘মার্কিন জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন’। বৈঠকের পরপরই ট্রাম্প নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লেখেন: ‘আমি নিশ্চিত হয়েছি, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত নন, যদি আমেরিকা এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। শান্তির জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর তিনি ফিরে আসতে পারেন।’ হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে ফ্লোরিডার বাসভবনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, জেলেনস্কির বোঝা উচিত যে তিনি এ যুদ্ধে হারছেন। ‘তাকে বলতে হবে, ‘আমি শান্তি চাই।’ ‘পুতিন এটা, পুতিন ওটা’ শুধু এ সব নেতিবাচক কথা বলে লাভ নেই। তাকে বলতে হবে, ‘আমি শান্তি স্থাপন করতে চাই। আমি আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাই না,’ বলেন ট্রাম্প। বৈঠকের পর ফক্স নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি বলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক এখনও ঠিক করা সম্ভব। এরপর কিছুটা অনুশোচনা প্রকাশ করে যোগ করেন, ‘এর জন্য আমি দুঃখিত।’ কংগ্রেসে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টি এই ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও ডেমোক্র্যাটরা তার আচরণের কঠোর সমালোচনা করেন। বৈঠক চলাকালীন ইংরেজিতে কথা বলার সময় ট্রাম্প ও ভ্যান্সের তীব্র বক্তব্যের নিচে জেলেনস্কির কথা যেন একপ্রকার চাপা পড়ে যাচ্ছিল। ট্রাম্প বলেন, ‘আপনি ভালো অবস্থানে নেই। এখন আপনার হাতে তাস নেই। আমাদের সঙ্গে থাকলে আপনি সুযোগ পাবেন।’ জবাবে জেলনস্কি বলেন, ‘আমি তাস খেলছি না। আমি খুবই সিরিয়াস, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’

‘আপনি তাসই খেলছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছেন আপনি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন,’ পাল্টা বলেন ট্রাম্প। এদিকে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ এই পরিস্থিতি দেখে আনন্দ প্রকাশ করে টেলিগ্রামে লেখেন, ‘জেলেনস্কি নির্মম ধমক খেয়েছেন’। বৈঠকের পর ট্রাম্প তার দুই শীর্ষ সহকারীকে নির্দেশ দেন তারা যেন জেলেনস্কিকে জানান, বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে যদিও তখনও অতিথিদের জন্য দুপুরের খাবার পরিবেশন করার প্রস্তুতি চলছিল। একজন হোয়াইট হাউস কর্মকর্তার বরাতে এ তথ্য জানা গেছে। ওই কর্মকর্তা জানান, ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদল আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তাদের বিদায় নিতে বলা হয়। এই তিক্ত মনোমালিন্যের ফলে বহুল প্রত্যাশিত খনিজ সম্পদণ্ডসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। কিয়েভ আশা করছিল, এ চুক্তি ট্রাম্পকে ইউক্রেনের পক্ষে আনবে এবং কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের কাছ থেকে নতুন সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল করবে। কিন্তু ট্রাম্প আপাতত খনিজ সম্পদ চুক্তিটি পুনর্বিবেচনা করতে আগ্রহী নন বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন হোয়াইট হাউসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। যেসব ইউরোপীয় নেতা ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি যেন ইউক্রেনে মার্কিন সেনা মোতায়েন না করলেও অন্তত দেশটিকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেন, তাদের প্রচেষ্টাকেও ব্যাহত করেছে এই উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা। কিন্তু তার বদলে ট্রাম্প হুমকি দেন, তিনি ইউক্রেনের পেছন থেকে মার্কিন সমর্থন সরিয়ে নেবেন।

তিনি জেলেনস্কিকে বলেন, ‘আপনারা হয় একটা চুক্তি করবে, নাহলে আমরা সরে যাব। আর আমরা যদি সরে যাই, তাহলে যুদ্ধটা আপনাদেরই লড়তে হবে। আমি মনে করি না, সেটা ভালো কিছু হবে।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘আমরা চুক্তি সই করলেই আপনাদের অবস্থান অনেক ভালো হবে। কিন্তু আপনি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছ না, আর এটা ভালো নয়। আমি খোলাখুলিই বলছি—এটা মোটেও ভালো ব্যাপার নয়।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, পুতিন আলোচনায় আগ্রহী। ভ্যান্সও সুর চড়িয়ে বলেন, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রকে অসম্মান করেছেন। ট্রাম্পও এতে সায় দেন। ‘আপনি ধন্যবাদ দেননি,’ বলেন ভ্যান্স। উত্তরে জেলেনস্কি গলা চড়িয়ে বলেন, ‘আমি বহুবার আমেরিকার জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছি!’ বাইডেন প্রশাসনের সময়কার বিপুল অস্ত্র ও নৈতিক সমর্থন পাওয়া জেলেনস্কি ট্রাম্পের কাছ থেকে একেবারেই ভিন্ন আচরণ পাচ্ছেন। ট্রাম্প দ্রুত যুদ্ধের অবসান চান। সেই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নও চান।