মসজিদ একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান। তা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, মানুষের অনুদান কিংবা মসজিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উৎস থেকে সংগৃহীত হলেও তা মসজিদের নিজস্ব সম্পদ। উক্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছে শরিয়ত।
মসজিদ কী?
ব্যাপক অর্থে নামাজ পড়া যায়, এমন স্থানকে মসজিদ বলা হয়। তবে পারিভাষিক মসজিদ ভিন্ন। যে স্থানকে নামাজের উদ্দেশ্যে ওয়াকফ করা হয়, এরপর সেখানে এক ওয়াক্ত হলেও জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা হয়, তাকে মসজিদ বলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মসজিদগুলো আল্লাহর। অতএব, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কারও ইবাদত কোরো না।’ (সুরা জিন : ১৮)।
মসজিদের ওয়াকফ কী?
মসজিদের ওয়াকফ দু’ধরনের। ১. যে অংশটি নামাজ আদায়ের জন্য ওয়াকফ করা হয়, ২. উক্ত মসজিদের প্রয়োজনে ওয়াকফকৃত অন্যান্য অংশ। যেমন বারান্দা, মাঠ, অজুখানা, হাউস ইত্যাদি। প্রকৃতার্থে প্রথম ধরনের অংশকেই মসজিদ বলা হয়। ওই অংশে প্রবেশের সময় দোয়া পড়তে হয়; নাপাক অবস্থায় প্রবেশ করা যায় না ইত্যাদি। অবশিষ্ট অংশ মসজিদের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
মসজিদ ব্যবস্থাপনার ভিত্তি
মসজিদ প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাসহ যাবতীয় কাজ হবে বিশুদ্ধ নিয়তে তাকওয়ার ভিত্তিতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে মসজিদ তাকওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেখানে নামাজে দাঁড়ানোই আপনার জন্য অধিক সঙ্গত।’ (সুরা তওবা : ১৩)।
মসজিদের আয়ের উৎস
মসজিদের যেহেতু বিভিন্ন ব্যয় নির্বাহ করতে হয়, তাই এর যথাযথ আয়ের ব্যবস্থাপনা করা মোতাওয়াল্লি ও কমিটির অন্যতম দায়িত্ব। মসজিদের আয়ের দুটি পন্থা হতে পারে একটি মসজিদের নিজস্ব সম্পদ থেকে। যেমন ফসলি জমি, দোকান-পাট, বাগান ইত্যাদি। উৎস থেকে আয়ের ক্ষেত্রে ওয়াকফকারীর শর্ত ও মসজিদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা আবশ্যক। আয়ের দ্বিতীয় মাধ্যম সাধারণ দান। যা বিভিন্ন অনুদান, মাসিক বা সাপ্তাহিক দান বাক্সের মাধ্যমে অথবা ব্যক্তি বিশেষ বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অনুদান ইত্যাদি। মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৬-এর ২২নং ধারায় আয়ের একটি উৎস বলা হয়েছে, ‘মসজিদের ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত অর্থ হতে আয় (মুনাফা)।’ ব্যাংক থেকে আয়কে মসজিদের জন্য একটি আয়-উৎস হিসেবে অনুমোদন করা হয়েছে। অপরদিকে ২১নং ধারার উপধারা ২-এ বলা হয়েছে, যেকোনো তফসিলি ব্যাংকে মসজিদের নামে একটি সুদমুক্ত হিসাব থাকবে।
মসজিদের সম্পত্তি ইজারা দেওয়া
মসজিদের সম্পদ দীর্ঘমেয়াদি ইজারায় প্রদান করা যাবে না। এতে সম্পদ বেহাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন কোনো ঘর বা দোকান এক বছরের চেয়ে বেশি সময়ের জন্য ইজারা দেওয়া। আবাদের জন্য কোনো জমি ৩ বছরের বেশি সময়ের জন্য লিজ দেওয়া। তবে ক্ষেত্র বিশেষ মসজিদের জন্য কল্যাণকর এবং এতে সম্পত্তি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে দীর্ঘমেয়াদের জন্যও ইজারা দেওয়া যেতে পারে। যেমন বর্তমানে মার্কেট বা শপিংমল নির্মাণ করে দোকান ভাড়া দেওয়া ইত্যাদি। (ইসলাম কা নেজামে আওকাফ : ৩১৪)। তবে তা অবশ্যই ন্যায্য ভাড়ায় ও নিরাপদ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে হতে হবে। ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে কম বা বিশ্বস্ততায় প্রশ্ন আসে, এমন ক্ষেত্রে ইজারা দেওয়া যাবে না। যেমন কমিটির কোনো সদস্যের ইজারা নেওয়া, মোতাওয়াল্লি তার সন্তানের কাছে ইজারা দেওয়া, নিজের স্ত্রীর নামে ইজারা দেওয়া ইত্যাদি। এগুলো বৈধ নয়। (শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড ৩৩, ধারা : ৬/১ ও ৫/৩/২)।
ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের বেতন-ভাতা
ইমাম ও মুয়াজ্জিনসহ মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বেতন-ভাতা ব্যবস্থাপনা করার দায়িত্ব মোতাওয়াল্লির। তাদের জন্য সম্মানজনক বেতন নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয়। মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৬-এর ২০নং ধারায় সিনিয়র পেশ ইমামের বেতন ৫ স্তরের স্কেলে, মুয়াজ্জিনের বেতন ১১তম স্তরের স্কেলে এবং খাদেমের বেতন ১৫ বা ১৬তম স্কেলে নির্ধারণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি আরও বিবেচনার প্রয়োজন। কারণ, জাতীয় পর্যায়ে নৈতিকতা ও উন্নত মননশীলতা এবং সমাজ বিনির্মাণে ইমামদের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তার স্বীকৃতি উক্ত নীতিমালায় ফুটে ওঠেনি। উপরন্তু এর প্রভাব প্রায় প্রতিটি মসজিদে পরিলক্ষিত হয়। ফলে মসজিদ কেন্দ্রিক দ্বীনি কার্যক্রমের সুবিশাল সম্ভাবনা দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
ব্যয়
মূলত ওয়াকফনামায় বর্ণিত যেকোনো বৈধ খাতে ব্যয় করা যাবে। যার মধ্যে মসজিদের নির্মাণ, উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় সংস্কার, আলোর ব্যবস্থা, পানি ও সেনিটেশনের ব্যবস্থা, ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের ভাতা, মসজিদ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা খরচসহ যেগুলো মসজিদের প্রয়োজন বলে বিবেচিত, তাতে ব্যয় করা যাবে। (ইসলাম কা নেজামে আওকাফ : ৪৭৫)। তবে ওয়াকফনামায় অনুমোদন নেই বা একান্ত প্রয়োজনীয় নয়, এমন ক্ষেত্রে খরচ করা যাবে না। যেমন নকশা ও কারুকার্য করা, অতিরিক্ত সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ফোয়ারা, ফুলবাগান, বৈঠকখানা ইত্যাদি নির্মাণ করা। এর জন্য স্বতন্ত্র ফান্ড তৈরি করে সেখানে যারা দান করবে, তা থেকে খরচ করা যাবে। কোনো দাতা খাত নির্দিষ্ট করে দান করলে বা সুনির্দিষ্ট কোনো খাতের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা হলে তা অন্য খাতে ব্যয় করা যাবে না। যেমন মসজিদের কার্পেট কেনার জন্য, অজুখানা নির্মাণের জন্য, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বোনাস প্রদানের জন্য বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য অনুদান সংগ্রহ করা হলো; তখন তা অন্য খাতে ব্যবহার করতে হলে দাতাদের অনুমতি নিতে হবে।
মসজিদের অর্থ করজ নেওয়া-দেওয়া
কোনো কোনো মসজিদে দেখা যায়, কমিটির কোনো সদস্য অথবা মোতাওয়াল্লি নিজের নামে মসজিদ থেকে করজ গ্রহণ করেন। এটি বৈধ নয়। কারণ, মসজিদের অর্থ কাউকে করজ দেওয়া যাবে না এবং মসজিদের বাইরে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনেও ব্যবহার করা যাবে না। (ইমদাদুল আহকাম : ৩/১৭৮)।
হারাম সম্পদ থেকে আমদানি
বর্তমানে আয়-উপার্জনে মানুষের বাছবিচার দিন দিন আশঙ্কাজনভাবে কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, মসজিদে সংগৃহীত চাঁদা বা অনুদান নিয়েও অনেকের মনে সংশয় কাজ করে, চাঁদা হালাল অর্থ থেকে দেওয়ার ব্যাপারে দাতাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কি-না! এ বিষয়ে শরিয়তের নির্দেশনা হলো, দাতার অর্থ হারাম হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলে তাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। হারাম উপার্জন থেকে মসজিদের জন্য কেউ দান করলে তার দায় দানকারীর ওপর বর্তাবে। তবে কারও আয়ের একমাত্র মাধ্যম হারাম হওয়ার বিষয়টি জানা থাকলে তার দান গ্রহণ করা যাবে না। (প্রাগুক্ত)।
বার্ষিক নিরীক্ষণ
মসজিদ কমিটি বা মোতাওয়াল্লির কর্তব্য হলো, আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসেব যাচাই-বাছাই করে সংরক্ষণ করা; বিশ্বস্ততায় প্রশ্ন ওঠে, এমন যেকোনো লেনদেন থেকে বিরত থাকা; বছরে অন্তত একবার স্বাধীন কোনো পক্ষের মাধ্যমে হিসেব নিরীক্ষণ করানো এবং মুসল্লিদের নিয়ে সাধারণ সভার আয়োজন করে তা সবাইকে অবগত করা। যেমনটি মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৬-এর ধারা ২১-এ বলা হয়েছে।
শরিয়া নিরীক্ষণ
মসজিদ একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার আয়-ব্যয়ে শরিয়া পরিপালন হচ্ছে কি-না, মসজিদ পরিচালনা কমিটি এ বিষয়ে আমানতদার। আমানতের দায়িত্ব থেকে হিসাবকে স্বাধীন কোনো পক্ষ থেকে প্রতি বছর সাধারণ অডিটের পাশাপাশি একটি শরিয়া অডিটও করানো জরুরি। কারণ শুধু হিসেব সংরক্ষণ করাটাই আমানতদারিতা নয়; বরং মসজিদের আয়-ব্যয় ও অন্যান্য কার্যক্রমে শরিয়া পরিপালন যথাযথভাবে হয়েছে কি-না, তা নিশ্চিত করাও আমানতদারিতার অংশ। বহির্বিশ্বে শরিয়া অডিটের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে আমাদের দেশে শরিয়া অডিটবিষয়ক সেবা দেওয়ার মতো এখনও পর্যন্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠান আইএফএ কনসালটেন্সি লিমিটেড। ইমাম গাজালি (রহ.) লিখেছেন, ‘সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখে ওমর (রা.) মোতাওয়াল্লি ও অন্যান্য দায়িত্বশীলকে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং হিসেব নিতেন।’ (আন নিজামুল কানুনি লি ইদারাতিল ওয়াকফ : ১৬৪)।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা, ইমাম ও খতিব, বাইতুস সালাম জামে মসজিদ, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা