ঢাকা শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলামে রিজিকের কথকতা

ইসলামে রিজিকের কথকতা

আল্লাহতায়ালা যেমনিভাবে আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তেমনি রিজিকদাতাও। জীবনের নানা পর্যায়ে আমরা তার রিজিক লাভ করে থাকি। আমাদের ওপর আল্লাহর অগণিত নেয়ামতের মধ্যে রিজিক অন্যতম। প্রতিটি মানুষই রিজিকের মুখাপেক্ষী। তাই মানুষের অধিকাংশ কাজকর্ম হয়ে থাকে রিজিক কেন্দ্রিক।

অভিধানে রিজিক

‘রিজিক’ শব্দটি আরবি। প্রাচীন অভিধানপ্রণেতা আল্লামা ইবনে ফারেস (রহ.) বলেন, ‘রিজিক হলো, সময় অনুযায়ী দান। এরপর শব্দটি শুধু দান অর্থে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং রিজিক হলো, মহান আল্লাহর বিশেষ দান।’ (মাকায়িসুল লোগাহ : ৩৩৩)। বিখ্যাত আরবি অভিধানপ্রণেতা আল্লামা আবু নসর জাওহারি (রহ.) বলেন, ‘যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়, তা-ই রিজিক। তদ্রুপ রিজিক মানে বিশেষ দানও।’ (আস সিহাহ : ৪৪০)। আল্লামা ইবনে মানজুর (রহ.) বলেন, ‘রিজিক দু’প্রকার ১. দেহের জন্য; যেমন খাদ্য, ২. অন্তর ও আত্মার জন্য; যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞান।’ (লিসানুল আরব : ৫/২৩৯)। মোটকথা, রিজিক হলো আল্লাহর এমন বিশেষ দান, যা দ্বারা সময় অনুযায়ী দেহ ও আত্মার উপকার লাভ হয় এবং যা লাভ করার পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়। তবে এসবের মধ্যে মূল অর্থ হলো খাদ্য; যা দ্বারা প্রাণ বেঁচে থাকে ও দেহের বৃদ্ধি ঘটে।

কোরআনুল কারিমে ‘রিজিক’ শব্দের ব্যবহার

কোরআনুল কারিমে আলিফ-লাম যুক্ত হয়ে ‘রিজিক’ শব্দটি অন্তত ৩৯ বার ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া আলিফ-লাম ছাড়া বিভিন্ন রূপান্তরে ব্যবহৃত হয়েছে অন্তত ২২ বার। মোট ৬১টি স্থানে ‘রিজিক’ শব্দটি উল্লিখিত রয়েছে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর।’ (সুরা হুদ : ৬)। মৌলিকভাবে কোরআনুল কারিমে যেসব স্থানে ‘রিজিক’ শব্দটি এসেছে, তাতে পূর্বোল্লিখিত রিজিকের মূল অর্থকে নির্দেশ করছে। তা হলো খাদ্য; যা থেকে প্রাণীরা তাদের খাবারের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। যার মাধ্যমে তার প্রাণ বেঁচে থাকে ও দেহ বৃদ্ধি পায়। (মাআরিফুল কোরআন : ৪/৫৯০)।

পরিভাষায় রিজিক

পরিভাষায় রিজিক বলতে প্রাণীদের প্রাণ ধারণের জন্য আল্লাহতায়ালার এমন বিশেষ দানকে বোঝানো হয়, যা নির্ধারিত সময়ে প্রদান করা হয় এবং তা তার (প্রাণ রক্ষা বা দৈহিক বৃদ্ধিতে তদ্রুপ বিশ্বাস, জ্ঞানসহ সামগ্রিক উন্নতিতে) উপকারে আসে। তাই রিজিক লাভ হয় তার নির্ধারিত সময়ানুযায়ী। রিজিক সেটাই, যা বান্দার উপকারে আসে। এই উপকারে আসাটা ব্যাপক। অর্থাৎ যা দুনিয়া ও পরকালে উপকারে আসে। সুতরাং হারাম খাদ্য এর অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং যা হালাল, তাই রিজিক। অনুরূপভাবে যা দেহের খোরাক মেটায়, তা যেমন রিজিক, তেমনি যা আত্মার খোরাক মেটায়, তাও রিজিক।

রিজিকের প্রকার

রিজিক বলতে সাধারণত সম্পদকে মনে করা হয়। তবে ইসলামে রিজিকের ধারণা আরও ব্যাপক। মৌলিকভাবে সম্পদ ছাড়াও মোটা দাগের যে বিষয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত, তা হলো ১. ঈমান, ২. ইলমে দ্বীন ও ফিকহ, ৩. সুস্থতা, ৪. নেককার স্ত্রী, ৫. নেককার সন্তান, ইত্যাদি। মোটকথা, দুনিয়া ও পরকালের জীবনকে সফল করে, এমন সব উপকরণই রিজিকের অন্তর্ভুক্ত।

হারাম বস্তুকে রিজিক বলা যায়?

চুরি করা অর্থে খাবার খেয়ে খিদে মেটালে তাকে রিজিক বলার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, তার খিদে দূর হওয়ায় তাও রিজিক। তবে অগ্রগণ্য কথা হলো, এর দ্বারা তার খিদে মিটলেও পরকালে সে শাস্তির সম্মুখীন হবে। তাই তা সব দিক থেকে বান্দার উপকারে এলো না। অথচ রিজিক মানেই হলো, যা বান্দার উপকারে আসে।

রিজিক সংক্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস

রিজিক সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আকিদা ৫টি। যথা

রিজিকদাতা একমাত্র আল্লাহতায়ালা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রিজিকদাতা, শক্তির আধার ও পরাক্রান্ত।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৮)। আল্লাহতায়ালা একমাত্র রিজিকদাতা হওয়ার বিষয়টি এ আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। আল্লাহ রিজিকদাতা হলে রিজিক তালাশ করতে হয় কেন? এর উত্তর সহজ। বান্দার কাজ রিজিক তালাশ করা। এ প্রক্রিয়ায় সে রিজিক পাবে। সরকারের কাজ নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করা। তবে এর জন্য আগে দেশের নাগরিক হতে হবে ও সরকারের আইন অনুযায়ী চলতে হবে। তদ্রুপ আল্লাহ রিজিকদাতা হলে মানুষ ক্ষুধার্ত হয়ে মারা যায় কেন? ওলামায়ে কেরাম এর অনেক উত্তর দিয়েছেন। সবচেয়ে সঠিক উত্তর হলো, এভাবে মৃত্যু হওয়াটা তার জন্য অবধারিত ছিল। এর সঙ্গে আল্লাহ রিজিকদাতা হওয়ার কোনো সংঘর্ষ নেই।

রিজিক আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব নির্ধারিত ও বণ্টিত : রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি (অর্থাৎ তার মূল উপাদান প্রথমে) ৪০ দিন তার মায়ের গর্ভে (আবশ্যিক পরিবর্তনের সঙ্গে শুক্ররূপে) থাকে। তারপর ৪০ দিন লাল জমাট রক্তপি-রূপে রূপান্তরিত হয়। তারপর ৪০ দিনে গোশতের টুকরোর রূপ ধারণ করে। অবশেষে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাকে পাঠান। তখন সে তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেয়। অতঃপর ফেরেশতাকে ওই গর্ভস্থ শিশুর ব্যাপারে চারটি বিষয় চূড়ান্তরূপে লিখতে আদেশ করা হয়। যথা তার রিজিক, মৃত্যু ও আমল। (অর্থাৎ সে কী আমল করবে এবং তা বদ না নেক হবে।’ (মুসলিম : ২৬৪৩)।

যা লাভ করেছি, পূর্ব নির্ধারিত হওয়ার কারণেই পেয়েছি : এ বিষয়টি আগের হাদিস থেকেই স্পষ্ট।

যা পাইনি, তা নির্ধারিত ছিল না বলে পাইনি : এটিও পূর্বোক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত।

যা নির্ধারিত, তা অবশ্যই পাব : রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে লোকসব! আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় রিজিক অন্বেষণ করো। কেননা, কোনো প্রাণী তার জন্য বরাদ্দকৃত রিজিক পূর্ণরূপে গ্রহণ না করে কখনোই মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও রিজিক লাভ করাটা বিলম্ব হয়। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় রিজিক তালাশ করো। যা শরিয়তে হালাল, তা গ্রহণ করো। হারাম পরিত্যাগ করো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৪৪)। এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, রিজিক হিসেবে আল্লাহতায়ালা যা বরাদ্দ রেখেছেন, তা অবশ্যই পাব। যদিও তা বিলম্ব হয়। সঙ্গে আরও বোঝা গেল, বিলম্ব হলে অস্থির হয়ে হারাম পথে রিজিক তালাশ করা যাবে না। পেরেশান হওয়া যাবে না; বরং ধৈর্যধারণ করতে হবে ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় রিজিক অন্বেষণ করা অব্যাহত রাখতে হবে। এরপর নির্ধারিত সময়ে তা লাভ হবে, ইনশাআল্লাহ।

রিজিক সংক্রান্ত ৫ আকিদার বাস্তব ফলাফল

রিজিক সংক্রান্ত উপরিউক্ত ৫টি আকিদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আকিদাগুলো যদি কেউ তার অন্তরে বদ্ধমূল করে নেয়, তাহলে সে দুনিয়া ও পরকালে সফল হবে। যেমন প্রথম আকিদা লালনের ফলাফল হলো, আল্লাহর প্রতি মহব্বত বৃদ্ধি পাবে। যখন ভাতের লোকমা মুখে দেব, আর মনে-প্রাণে বিশ্বাস করব, এ লোকমা আল্লাহর বিশেষ দান, তখন তনুমন আল্লাহর মহব্বতে ভরপুর হবে। এরপর আজান হলে মসজিদে যেতে কষ্টবোধ হবে না। এ মহব্বতের কারণে হারাম উপার্জন থেকেও বিরত থাকা যাবে। তদ্রুপ এ আকিদা যখন বদ্ধমূল হবে, মায়ের পেটে থাকাবস্থায়ই রিজিক সুনির্ধারিত হয়ে গেছে, তখন রিজিক নিয়ে পেরেশানি থাকবে না। যা পেয়েছি, তা পাওয়ার ছিল বলেই পেয়েছি। যা পাইনি, তা নিয়ে আফসোস থাকবে না। তৃতীয় ও চতুর্থ আকিদা থেকে এ ফলাফলগুলো আরও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ পাবে। অন্যের সম্পদ ও সুখ দেখে কষ্ট হবে না। বরং নিজের প্রাপ্তি দেখে অন্তর কৃতজ্ঞ থাকবে। সবশেষে যখন এ বিশ্বাস করব, আমাদের জন্য যে রিজিক বরাদ্দকৃত, তা অবশ্যই পাব, তখন অধৈর্য হয়ে হারাম পথে রিজিক তালাশ করার প্রয়োজন পড়বে না। এতে চুরি-ডাকাতি, ঘুষ, রাহাজানিসহ যাবতীয় অর্থ-সংক্রান্ত অন্যায় কাজ অনায়াসে বন্ধ হয়ে যাবে।

লেখক : সিএসএএ, অ্যাওফি, বাহরাইন

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আইএফএ কনসালটেন্সি লি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত