বর্তমান সমাজে অনেকটা ওয়াকফের মতোই প্রচলিত কয়েকটি ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন- সোসাইটি, ট্রাস্ট, এন্ডোমেন্ট, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। অনেক গবেষক মনে করেন, এগুলোর মূল চিন্তা ইসলামের ওয়াকফ ব্যবস্থা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষত ১৮৮২ সালের ২ নম্বর ট্রাস্ট আইন দ্বারা ট্রাস্টের ধারণা ওয়াকফ থেকে গৃহীত হওয়ার বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। কারণ, বাংলায় এটিকে অছি আইন বলা হয়। অছি বা অসিয়ত ও ওয়াকফের মধ্যে বিভিন্ন বিধানে অনেক সম্পর্ক রয়েছে। আগের যুগের ফকিহ ও আলেমদের অনেকেই ওয়াকফ ও অসিয়তের বিধান একই শিরোনামে আলোচনা করেছেন। তাই বর্তমানের ট্রাস্ট এবং অতীতের ওয়াকফের মধ্যে বেশ কিছু মিল রয়েছে। যার ফলে অনেকে ট্রাস্ট ও ওয়াকফকে অভিন্নও মনে করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটি ওয়াকফ সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ধারণা। কারণ, ট্রাস্ট এবং ওয়াকফের দৃশ্যমান কিছু মিল থাকলেও এ দুইয়ের মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ রয়েছে। প্রচলিত ট্রাস্টসহ আরও কয়েকটি পরিভাষা-পরিচিতি উল্লেখ করার পর মিল-অমিলের দিকগুলো উপস্থাপন করা হলো-
ফাউন্ডেশন
ফাউন্ডেশন সাধারণত ধর্মীয় বা সামাজিক সেবামূলক উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়ে থাকে। অনেক সময় মৃত ব্যক্তির নামেও করা হয়ে থাকে। যেমন- সাজেদা ফাউন্ডেশন, অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন ইত্যাদি।
এন্ডোমেন্ট
এন্ডোমেন্ট হলো, কোনো অলাভজনক সংস্থাকে অর্থ বা সম্পত্তি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে দান করা। আর উক্ত সম্পত্তি বিনিয়োগ করে যে আয় হবে, তা দ্বারা উদ্দিষ্ট কল্যাণমূলক কাজ করা।
সোসাইটি
সোসাইটিও অনেকটা ফাউন্ডেশনের মতোই। তবে অলাভজনক সামাজিক কার্যক্রম ও জনসেবার উদ্দেশ্য এখানে মূলবিষয়। যেমন- বৃক্ষরোপণ, বনায়ন, অসহায়-দরিদ্র লোকদের সেবা ইত্যাদি।
ফাউন্ডেশন, সোসাইটি বা এন্ডোমেন্ট গঠন করার জন্য প্রথমে অন্তত ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে হয়। তা ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য বিষয়ে তার সংবিধান থাকতে হয়। এরপর সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন ও অনুমোদনের মাধ্যমে তা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে অস্তিত্ব লাভ করে। সংক্ষেপে বললে, এগুলোর জন্য দেশীয় আইনের স্বীকৃতি বাধ্যতামূলক। ধর্মীয় উদ্দেশ্যেও এগুলোর ব্যবহার রয়েছে। তবে নিরপেক্ষ উদ্দেশ্যগুলো (যেমন- সমাজ ও জনকল্যাণের চেতনা) এখানে প্রধান ও মূল হিসেবে দেখা হয়।
ট্রাস্ট
১৮৮২ সালের ট্রাস্ট আইনে এর পরিচিতি দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘কোনো সম্পদকে তার মালিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একজন ট্রাস্টির নিয়ন্ত্রণে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি তথা বেনিফিসিয়ারির জন্য তার উপযোগকে প্রদান করা।’
১৮৮২ সালের ট্রাস্ট আইনের ৩ ধারার ট্রাস্টের ব্যাখ্যা হলো, ‘ট্রাস্ট হলো, সম্পত্তির মালিকানার সঙ্গে সংযুক্ত দায়িত্ব; যা অন্যের বা অন্যের ও মালিকের উপকারার্থে মালিকের ওপর অর্পিত ও মালিক কর্তৃক গৃহীত অথবা তৎকর্তৃক ঘোষিত ও গৃহীত আস্থা থেকে উদ্ভুত।’ সহজ ভাষায় ট্রাস্ট হলো, একজনের সম্পত্তি অপরের উপকারার্থে অন্যের হাতে সমর্পণ করা। একটি উদাহরণের মাধ্যমে ট্রাস্টকে বোঝানো যেতে পারে। যেমন- ফাহিম তার সম্পত্তি নাহিদের কল্যাণে শফিকের কাছে অর্পণ করল। হয়ে গেল ট্রাস্ট সৃষ্টি। যে ট্রাস্ট করে, তাকে বলা হয় ট্রাস্ট কর্তা। যে ট্রাস্ট গ্রহণ করে বা যার বরাবরে ট্রাস্ট করা হয়, তাকে বলা হয় ট্রাস্টি। যার উপকারার্থে ট্রাস্ট করা হয়, তাকে বলা হয় লাভভোগী। যে সম্পত্তি নিয়ে ট্রাস্ট করা হয়, তাকে বলা হয় ট্রাস্ট সম্পত্তি। যে দলিলের মাধ্যমে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা হয়, তাকে বলা হয় ট্রাস্ট দলিল।
ট্রাস্টের আবশ্যকীয় উপাদান
বৈধ ট্রাস্টের কয়েকটি অপরিহার্য উপাদান রয়েছে। সার্বজনিক ট্রাস্ট আইন ২০১৭ (খসড়া) ধারা ৫-এ বলা হয়েছে, ‘ট্রাস্টকারী যখন ট্রাস্ট সম্পত্তি সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত নিশ্চয়তার সহিত কোনো কথা বা কাজের দ্বারা নির্দেশ প্রদান করে এবং (ক) তাহার পক্ষ হইতে ট্রাস্ট সৃষ্টির ইচ্ছা, (খ) ট্রাস্টের উদ্দেশ্য, (গ) সুবিধাভোগী এবং (ঘ) ট্রাস্টি বরাবর ট্রাস্ট সম্পত্তি হস্তান্তর করে (যদি না উইলের মাধ্যমে ট্রাস্ট ঘোষণা করা হয় অথবা ট্রাস্টকারী নিজেই ট্রাস্টি না হয়), তখনই ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা হইবে।’
বোঝা গেল, বর্তমান সময়ের ট্রাস্ট এবং ইসলামের ওয়াকফের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। ওয়াকফের যেমন মাওকুফ আলাইহিম (যাদের উদ্দেশে ওয়াকফ করা হয়) থাকে, তেমনি ট্রাস্টেও বেনিফিসিয়ারি রয়েছে। ওয়াকফের যেমন মোতাওয়াল্লি থাকে, অনুরূপ ট্রাস্টেও একজন ট্রাস্টি থাকে; সে ট্রাস্টকে দেখাশোনা এবং তত্ত্বাবধান করে। এ কারণে অনেকে ট্রাস্ট ও ওয়াকফকে একই রকম মনে করেছেন। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ, এ দুইয়ের মধ্যে অমিল ও পার্থক্যের দিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এ পার্থক্য দু’রকমের- একটি আদর্শিক এবং অপরটি ব্যবহারিক ও বৈশিষ্ট্যগত। মোটা দাগের কয়েকটি পার্থক্য উল্লেখ করা হলো-
আদর্শগত পার্থক্য
এক. ওয়াকফ সম্পূর্ণ ইসলামি ও ধর্মীয় চেতনাসমৃদ্ধ কল্যাণমূলক একটি ব্যবস্থা। পরকালে সওয়াব লাভের আশা, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার বাসনা এবং মানবতার প্রতি সহানুভূতি ও সেবার মানসিকতা এখানে মূলবিষয়। ওয়াকফ সূচনার ইতিহাস তালাশ করলে দেখা যায়, রাসুল (সা.) পানির কূপ ওয়াকফ করতে উৎসাহিত করেছেন জান্নাতের বিনিময়ে। আল্লাহতায়ালা তাঁর কল্যাণ ও ভালোবাসা প্রাপ্তির জন্য প্রিয় জিনিস দান করতে বললে সাহাবিরা প্রিয় জমি, বাগান ও অন্যান্য বস্তু ওয়াকফ করার মাধ্যমে এ আমল শুরু করেন। অতএব, এ কথা স্পষ্ট যে, ওয়াকফ মূলত ধর্মীয় ও ইসলামি ব্যবস্থা। যা থেকে দানকারী সদকায়ে জারিয়া তথা স্থায়ীভাবে পরকালে সওয়াব লাভ করতে থাকে। অপরদিকে ট্রাস্টের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা নেই। বরং ইসলামি শরিয়ার দৃষ্টিতে বৈধ নয়, এমন ক্ষেত্রেও ট্রাস্ট গঠন করা যায়।
দুই. ওয়াকফের মূল কথা হলো, ওয়াকফকৃত বস্তু থেকে ব্যক্তি তার মালিকানা স্বত্ব তুলে নিয়ে আল্লাহর মালিকানায় সোপর্দ করা এবং তার উপকার ও উপযোগ বেনিফিসিয়ারিদের প্রদান করা। কিন্তু ট্রাস্টের সম্পদ থেকে ট্রাস্টকারীর মালিকানা রহিত হয় না। কোনো কারণে ট্রাস্ট বিলুপ্ত হলে বা ব্যবহারের অনুপযোগী হলে কিংবা ট্রাস্টের মেয়াদ শেষ হলে তা পুনরায় ট্রাস্টকারীর মালিকানা হিসেবে গণ্য হয়।
বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য
১. ফাউন্ডেশন, সোসাইটি ইত্যাদি সৃষ্টি করার জন্য নিবন্ধন করা আবশ্যক। আইনগত পদ্ধতিতে অন্তত ৭ সদস্যের মাধ্যমে তা সৃষ্টি হয় ও অস্তিত্ব লাভ করে। কিন্তু ওয়াকফ মৌখিকভাবেই সম্পন্ন হয়ে যায়। কোনো আইনি স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। ট্রাস্ট অ্যাক্ট ১৮৮২ ধারা ৪-এ রয়েছে, ‘যে কোনো ট্রাস্ট আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে তা স্বীকৃত ও বৈধ হওয়া আবশ্যক।’
২. ওয়াকফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য জরুরি হলো, তা এমন কোনো উদ্দেশ্যে ওয়াকফ করতে হবে, যা ইসলামি শরিয়া কর্তৃক অনুমোদিত এবং তা সওয়াব লাভের উপায় হবে। যেমন- গরিবদের সহযোগিতা, এতিমদের লালন-পালন, হাজিদের পাথেয় জোগান কিংবা মসজিদণ্ডমাদরাসা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। কিন্তু ট্রাস্টের জন্য এসব অপরিহার্যতা নেই। বরং শরিয়া কর্তৃক অনুমোদিত নয়, এমন উদ্দেশ্যেও ট্রাস্ট হতে পারে। যেমন- মন্দির প্রতিষ্ঠা, গির্জা প্রতিষ্ঠা, কথিত চারুকলা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এসব খাতে ওয়াকফ করার সুযোগ নেই।
৩. ওয়াকফ করা হয় স্থায়ী খাতে এবং সব সময়ের জন্য। যা কখনও বিলুপ্ত করা যায় না। কিন্তু ট্রাস্ট সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেও হয়ে থাকে। ট্রাস্টের মালিক চাইলে তা বিলুপ্তও করতে পারে। কিন্তু ওয়াকফের মধ্যে অধিকাংশ ইমামের মতে একবার দান করা হয়ে গেলে তা আর কখনও ওয়াকিফকারীর মালিকানায় ফিরে আসে না। (ইসলাম কা নেজামে আওকাফ : ১৫৫)।
৪. ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহারের অনুপোযুক্ত হয়ে গেলে গ্রহণযোগ্য মতানুসারে সেই সম্পদ ওয়াকফকারীর মালিকানায় ফিরে আসে না। বরং তা বিক্রি করে অন্য কোনো উপকারী বস্তু ক্রয় করতে হবে এবং আগের ওয়াকফের পর্যায়ে তা ধর্তব্য হবে। (শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড ৩৩, ধারা : ৯/২)। পক্ষান্তরে ট্রাস্টের সম্পদ ব্যবহারের অনুপোযুক্ত হলে ট্রাস্ট সমাপ্ত বলে বিবেচিত হয় এবং ট্রাস্টকারী পুনরায় উক্ত সম্পদের মালিক হয়ে যায়। (দ্য ট্রাস্ট এ্যাক্ট ১৮৮২)।
৫. আইনের পার্থক্য : দেশীয় আইনের দিক থেকেও এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কারণ, ওয়াকফ পরিচালিত হয় ১৯৬২ সালের ওয়াকফ অধ্যাদেশ দ্বারা। অপরদিকে ট্রাস্ট পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় ১৮৮২ সালের ২নং আইন দ্বারা। উল্লিখিত, আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, ট্রাস্ট এবং ওয়াকফ ক্ষেত্রবিশেষ অভিন্ন হলেও এ দুইয়ের মধ্যে বাস্তব প্রয়োগ এবং উদ্দেশ্যগত দিক থেকে যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা
ইমাম ও খতিব, বাইতুস সালাম জামে মসজিদ, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা