ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জাকাত কি ও কেন

মুফতি লুকমান হাসান
জাকাত কি ও কেন

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সম্পদের বৈষম্য ভীতিকর এবং লজ্জাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। লাখো মানুষ আজ চরম বেকারত্ব, ঋণগ্রস্থতা, দুর্দশা, শিক্ষার সুযোগের অভাব, ক্ষুধা এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবসহ দরিদ্রতার অপ্রতিরোধ্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে। এ সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য আল্লাহতায়ালা একটি শক্তিশালী উপায় দিয়েছেন। তা হলো, জাকাত। এর মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করার অভাবনীয় সক্ষমতা রয়েছে। তা ছাড়া এটি বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের জন্যও শক্তিশালী উপায়। কারণ, জাকাত হলো সামাজিক সম্পদ পুনর্বণ্টনের একটি মানবিক মডেল এবং মানুষের লোভ ও সামাজিক অসমতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থা।

জাকাত কি?

জাকাত একটি আর্থিক ইবাদত; যা আল্লাহতায়ালা সামর্থ্যবানদের ওপর ফরজ করেছেন। ঈমান ও নামাজের পরই জাকাতের অবস্থান। এর মূল অর্থ হলো, পবিত্রতা, বৃদ্ধি, বরকত ও প্রশংসা। যেহেতু জাকাত দেওয়ার মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয় এবং জাকাত দেওয়ার কারণে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তাই জাকাতকে জাকাত বলে। শব্দটি কোরআনে কারিমে ৩৩ বারেরও বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি তাদের সম্পদ থেকে সদকা (জাকাত) গ্রহণ করো। যার মাধ্যমে তুমি তাদের পবিত্র ও বরকতপূর্ণ করবে এবং তাদের জন্য দোয়া করো। নিশ্চয়ই তোমার দোয়া তাদের পক্ষে প্রশান্তিদায়ক। আল্লাহ সব কথা শোনেন, সবকিছু জানেন।’ (সুরা তওবা : ১০৩)। রাসুল (সা.) মুআজ বিন জাবাল (রা.)-কে ইয়ামেনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করার সময় বলেছিলেন, ‘তুমি সেখানের অধিবাসীদের জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহতায়ালা তাদের ধনীদের ওপর জাকাত ফরজ করেছেন; যা তাদের গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হবে।’ (বোখারি : ১৩৯৫)।

জাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত

জাকাত আদায় সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কোরআনে কারিমে এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দান-সদকাকে বর্ধিত করে দেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৬)। জাকাত সম্পদকে নিরাপদ করে। এক হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা তোমাদের সম্পদকে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে দুর্গ বেষ্টিত (সংরক্ষিত) করো।’ (মারাসিল, আবু দাউদ : ১০৫)। আরেকটি হাদিসে এসেছে, ‘দান-সদকা (জাকাত) কখনোই সম্পদ হ্রাস করে না।’ (মুসলিম : ২৫৮৮)। অপরদিকে জাকাত আদায় না করার ভয়াবহতাও অনেক বেশি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা স্বর্ণ-রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় (জাকাত আদায়) করে না, তাদের যন্ত্রণাময় শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন সে ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, তারপর তা দ্বারা তাদের কপাল, তাদের পাঁজর ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। (বলা হবে) এই হচ্ছে সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে, তার মজা ভোগ করো।’ (সুরা তওবা : ৩৪-৩৫)।

হাদিসে জাকাত আদায় না করার পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যেই ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা সম্পদ দান করেছেন, অতঃপর সে তার জাকাত আদায় করেনি, কেয়ামতের দিন তার পুঞ্জীভূত সম্পদকে অতিশয় বিষধর সাপের রূপ দেওয়া হবে। যার চোখের ওপর দুটি কালো দাগ থাকবে। তারপর ওই সাপ তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুই পাশে দংশন করবে। বলবে, আমি তোমার সম্পদ। আমি তোমার সঞ্চয়।’ (বোখারি : ১৪০৩)।

জাকাতের উদ্দেশ্য

জাকাত ফরজ করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, আর্থিকভাবে আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামি করা। (কিতাবুন নাওয়াজেল : ৪৭)। এ ছাড়াও উক্ত ইবাদতের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন- গরিবদের প্রাপ্য প্রদান করা এবং দারিদ্র্য বিমোচন করা। (সুরা জারিয়াত : ১৯)। সম্পদ শুধু ধনী শ্রেণির হাতে পুঞ্জিভূত হতে না দেওয়া ইত্যাদি। (সুরা হাশর : ৭)। এগুলো জাকাত ফরজ করার প্রধান ও মৌলিক উদ্দেশ্য।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাকাত

জাকাত একটি আর্থিক ইবাদত। ইবাদত আদায়ের জায়গাকে সম্মান ও ভক্তি করতে হয়। যেমন- মসজিদ নামাজের স্থান হওয়ার কারণে তা সম্মান ও ভক্তির জায়গা। জাকাত আদায়ের ক্ষেত্র গরিব মানুষ। সুতরাং তারা সম্মান ও ভক্তির পাত্র। তাদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা রেখে জাকাত দিতে হবে। দ্বিতীয়ত ইবাদতে আদায়ের স্থানে গিয়ে তা আদায় করতে হয়। সুতরাং গরিবের কাছে গিয়ে জাকাত দিতে হয়। কারণ, সে ইবাদত আদায়ের ক্ষেত্র। এর ফলে ধনি-গরিবের মাঝে দূরত্ব কমে আসে। জাকাত মূলত সম্পদের ভারসাম্যহীনতা দূর করে মানবিক সম্পর্কের সূত্রে পরস্পরকে আবদ্ধ করে।

অতীত থেকে এর বাস্তব উদাহরণ খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর শাসনামল। তখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাতের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা ছিল। মানুষের মাঝে সম্পদের ভারসাম্যহীনতা ছিল না। সুদূর আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতেও সরকারি কর্মচারীরা জাকাতের উপযুক্ত লোক খুঁজে না পেয়ে বলেছিল, ‘ওমর বিন আবদুল আজিজ সব মানুষকে ধনী বানিয়ে দিয়েছে। জাকাত এখন কোথায় দেব?!’ (সিরাতু ওমর ইবনু আবদিল আজিজ)।

শায়খ ইউসুফ কারজাবি লিখেছেন, ‘জাকাত মূলত অলস জমে থাকা সম্পদকে বাজারে নিয়ে আসার একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। কারণ, আল্লাহতায়ালা সুরা তওবায় জাকাত না দিয়ে সম্পদকে পুঞ্জিভূত করে রাখতে হারাম করেছেন। সুতরাং জাকাত ব্যবস্থার কারণে বাজারে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং বাণিজ্যিক চাঞ্চল্য তৈরি হয়। তাই জাকাতের অর্থনৈতিক প্রভাব বলার অপেক্ষা রাখে না।’ (ফিকহুজ জাকাত : ৮৮৪)।

দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের সম্ভাবনা

মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে জাকাতের সম্ভাবনা অনেক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আজ যদি জাকাত ব্যবস্থাপনার যথাযথ উদ্যোগ থাকত, আর সম্পদশালী সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাকাত প্রদান করত, তাহলে রাষ্ট্রীয় বাজেটের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এ খাত থেকে পূর্ণ হয়ে যেত। শিক্ষা খাতে প্রতি বছরই বাজেটের একটি বৃহৎ অংশ নির্ধারিত থাকে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। যা জাতীয় মোট বাজেটের ১১.৯২ শতাংশ। এ থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বই-খাতা ও বৃত্তি প্রদান করা হয়। এ অংশটি খুব সহজেই জাকাতের মাধ্যমে ব্যবস্থা করা যায়।

শুধু তাই নয়, জাকাতের মাধ্যমে দেশের সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মাসিক ভাতা নির্ধারণ করা যেত। প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও বিধবা মানুষগুলো আমাদের সমাজে চরম অবহেলার শিকার। এ জনগোষ্ঠীকে খুব সহজে রাষ্ট্রীয় জাকাতের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। গরিবদের জন্য চলতি অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই জাকাত থেকে সরবরাহ করা সম্ভব।

বহু মানুষ অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে না। প্রতিটি হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের জন্য জাকাতের অর্থ বরাদ্দ রাখা যায়। সমাজের বহু পরিবার এমন আছে, যাদের সামান্য একটু পুঁজির ব্যবস্থা হলে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। দেশের বিভিন্ন তথাকথিত এনজিওগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে সুদভিত্তিক ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে দরিদ্রতার যাতাকলে মানুষকে নিষ্পেষিত করছে।

অনেক পিতা দরিদ্রতার কারণে মেয়েকে ভালো পাত্রস্থ করতে পারছেন না। অনেক অসহায় বিধবা নারী একটি সেলাই মেশিন হলে হালালভাবে উপার্জন করে জীবন ধারণ করতে পারেন। এ রকম বহু অভাব দূর করা যায় জাকাতের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের বিত্তবানদেন সাকুল্য জাকাত বছরে (একটি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের অনুসন্ধান অনুযায়ী) অন্যূন ৮ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে। এ টাকা পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করতে পারলে ৫ বছরেই বাংলাদেশের কঠিন দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। তবে প্রয়োজন শুধু সচেতনতা ও সঠিক পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার। বস্তুত জাকাত এমন একটি উন্নত ব্যবস্থা, এর মাধ্যমে ধনীদের অর্থ সরাসরি দরিদ্রদের কাছে চলে যায়। সম্পদে এক-কেন্দ্রিকতা হ্রাস পায়। (জাকাত : যা না জানলেই নয়)।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা; ইমাম ও খতিব, বাইতুস সালাম জামে মসজিদ, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত