মানব কল্যাণে ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা

ড. ফাতেমা মারজান

প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামি অর্থনীতি ইসলামি জীবন ব্যবস্থার এক অপরিহার্য অংশ। ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা মানবজাতির জন্য কল্যাণময়, বৈজ্ঞানিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ অর্থ ব্যবস্থা। ইসলামি অর্থনীতি পুঁজিবাদী বা সমাজবাদী যে কোনো অর্থ ব্যবস্থার তুলনায় প্রগতিশীল এবং মানবতার জন্য কল্যাণকর। ইসলামি অর্থনীতি ইসলামি আদর্শ, জীবনদর্শন ও সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইসলামি অর্থনীতি ইসলামি সমাজবিজ্ঞানেরই একটি শাখা। ইসলামি অর্থনীতির যেসব সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার সারকথা হচ্ছে, ইসলামি অর্থনীতি হচ্ছে একটি সমাজবিজ্ঞান, যা ইসলামের আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি আলোচনা করে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, ‘যে সমাজবিজ্ঞান ইসলামি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সমস্যা পর্যালোচনা করে, তাণ্ডই ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা।’ সহজ কথায় আল্লাহর দেওয়া ইসলামি বিধিনিষেধ রক্ষা করে, উৎপাদন, আয়, উপার্জন, ব্যয়-বণ্টন ও ভোগ-ব্যবহার সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলি পরিচালনার জ্ঞান ও বাস্তব কার্যক্রম গ্রহণ করে যে অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয় তাণ্ডই ইসলামি অর্থনীতি। ইসলাম বিশ্বমানবের জন্য স্থায়ী শান্তি ও কল্যাণময় অর্থ ব্যবস্থা পেশ করেছে। ইসলামি অর্থনীতির মাধ্যমেই মানুষের সব ধরনের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান ও স্থায়ী কল্যাণ সাধন করা যায়। কেননা, ইসলামি জীবন দর্শন, ধর্ম, কৃষ্টি ও সভ্যতা এবং অর্থনীতি একই সূত্রে গাঁথা। এ জন্য ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সমাজে পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা স্থাপিত হয়।

ইসলামি অর্থনীতির বিষয়বস্তু ও পরিধি

গণমানুষের যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা, যা ইসলামের আলোকে সমাধানযোগ্য। সেসব অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, যা কোরআন ও সুন্নাহ বিধৃত মূল্যবোধের গভীরে নিহিত। মানবকল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের সুষ্ঠু নিয়মনীতি, যা ইসলামি দৃষ্টিতে বিশ্লেষণমূলক। ইসলামি নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের অবকাঠামোর অধীনে সীমিত সম্পদের ব্যবহারিক প্রশাসন। ইসলামি অর্থনীতি কেবল মানবকল্যাণের বস্তুগত কারণগুলোই আলোচনা করে না; বরং ভোগ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিনিষেধ আলোচনা করে।

ইসলামি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য

সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির নয়; বরং সব সম্পদের ওপর একমাত্র আল্লাহর মালিকানা স্বীকৃত থাকবে। মানুষ ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে সম্পদের আমানতদার হবে, মালিক নয়।

আল্লাহর নেয়ামত তথা সম্পদে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের ভরণ-পোষণের অধিকার থাকবে। মানুষ সম্পদের অধিকারী হবে সাধারণত শ্রমের ভিত্তিতে। কিন্তু যাদের শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জনের শক্তি বা সুযোগ থাকবে না- যেমন পঙ্গু, বৃদ্ধ, বেকার- তাদের জন্য জাকাত বা অন্য কোনো ব্যবস্থার মাধ্যমে আর্থসামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। সীমিত অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তি (মালিকানা নয়) মানুষের থাকবে এবং উত্তরাধিকার আইনও চালু থাকবে।

সুদণ্ডজুয়া নিষিদ্ধ শ্রমবিহীন শোষণমূলক আয়ের পথ যেমন- সুদ ও জুয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প বা কৃষি থাকবে। তবে দুর্নীতি, চোরাচালানি, ওজনে কারচুপি, মজুদদারি, মুনাফাখোরি, ভেজাল মেশানো, অন্যায় জবরদখল ইত্যাদি কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ থাকবে।

বিলাসিতা, অপচয় কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মানুষ সহজ-সরল জীবনযাপন করবে। সম্পদের সুষম বণ্টন চালু হবে। অর্থাৎ মানুষ প্রয়োজন অনুপাতে সম্পদ ভোগ করবে। ধনবৈষম্যের যথাসাধ্য অবসান ঘটাতে হবে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে আসীন ব্যক্তিরা সাধারণ অর্থনৈতিক জীবনযাপন করে সবার সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর কারও নিরঙ্কুশ অধিকার তথা মালিকানা নেই। রাষ্ট্র জনগণের বৃহত্তর প্রয়োজনে কারও প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ উপযুক্ত ব্যবস্থাধীনে নিয়ে নিতে পারবে।

ব্যক্তি তার নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন পূরণের পর নিজের সম্পদ সমাজের অন্যান্য অভাবি লোকদের অভাব পূরণের জন্য তৈরি রাখবে।

কোন রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত সম্পদ দেশের প্রয়োজন পূরণের পর অন্য অভাবগ্রস্ত দেশের প্রয়োজন পূরণের জন্য তৈরি রাখতে হবে।

মানুষের জীবন রক্ষায় রক্ত সঞ্চালনের যে গুরুত্ব, যে কোনো দেশ বা সমাজের স্থিতি ও উন্নতিতে অর্থব্যবস্থার গুরুত্বও সেরূপ। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব কত বেশি তা উপলব্ধির জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে ঈমান ও নামাজের পর দ্বিতীয় স্থানে রাখা হয়েছে জাকাতকে। নিঃসন্দেহে জাকাত ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। জাকাতের সঙ্গে আছে ফিতরা, দান, সদকা, কাফফারা ইত্যাদির বিধান।

ইসলামি অর্থ ব্যবস্থায় কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিবেচ্য নয়, বরং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৈধ পন্থায় হচ্ছে, নাকি অবৈধ পন্থায়- তা অবশ্যই দেখতে হবে। এ জন্য হালাল-হারামের বিধান দেওয়া হয়েছে। ইসলামি অর্থ ব্যবস্থায় শোষণের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এ কারণে সুদকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে আর ব্যবসাকে হালাল করে দেওয়া হয়েছে। ঘুষের ব্যাপারেও ইসলামের নীতি অত্যন্ত কঠোর। জুয়া, চোরাচালান প্রভৃতি ভেতর থেকে আঘাত করে সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তিমূল ধসিয়ে দেয়। এ কারণে জুয়া, হাউজি, চোরাচালান, মজুতদারি প্রভৃতিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামে উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনের যে বিধান দেওয়া হয়েছে, তাও প্রমাণ করে যে, ইসলাম নিছক কোনো ধর্ম নয়, বরং মানবজীবনের সব দিক-বিভাগের সমাধান নির্দেশ করা হয়েছে ইসলামে। কাজেই ইসলামি অর্থব্যবস্থার কথা বলে যদি নির্দিষ্ট দু-একটি বিষয় নিয়ে চর্চা করা হয়, তাহলে ইসলামি অর্থব্যবস্থার সৌন্দর্য পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারবে না।