গোপন-প্রকাশ্যে যেকোনোভাবে দান করা যায়। সব দানেই সওয়াব রয়েছে। দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর মানুষের মাঝে রিজিকের ভারসাম্যতা রক্ষা করেন। বিনিময়ে প্রতিদানও দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা করো, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে আরও বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা : বাকারা : ২৭১)।
সদকা কাকে বলে?
ইসলামি পরিভাষায় দান করাকেই সদকা বলা হয়। সদকা শব্দটি এসেছে, আরবি ‘সিদকুন’ থেকে। অর্থ : সত্যতা, যথার্থতা। পরিভাষায় সদকা বলা হয়, একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার লক্ষ্যে স্বীয় সম্পদ ব্যয় করা। কারণ, মানুষের সর্বাপেক্ষা প্রিয়বস্তু এবং জীবনযাপনের প্রধান উপকরণ কষ্টার্জিত মাল ব্যয় করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার প্রতি ভালোবাসা এবং তার নির্দেশাবলীর প্রতি আনুগত্যের বাস্তব প্রমাণ দিয়ে থাকেন বলে এই ব্যয়কে সদকা নামে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআন হাদিসে অত্যাবশ্যক এবং ঐচ্ছিক এ উভয় প্রকার দানকেই সদকা বলা হয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে শুধুমাত্র ঐচ্ছিক নফল দানকেই সদকা বলা হয়ে থাকে।
সদকার ধরন
সদকা দুই প্রকার। (১) সাধারণ সদকা (২) সদকায়ে জারিয়া। গরিব-দুখীকে টাকাণ্ডপয়সা দান করা, ভালো ব্যবহার করা সাধারণ সদকার অন্তর্ভুক্ত। আর সাদকায়ে জারিয়া বলা হয় ওইসব সৎকর্ম, যেগুলোর কল্যাণকারিতা স্থায়ী হয়। এর মধ্যে সর্বাগ্রে হচ্ছে- দ্বীনি এলেম শিক্ষা দান, দ্বীনি বইপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করে সর্বসাধারণের মধ্যে এলেম পৌঁছানো। কারণ, দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে মানব সন্তানের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর বিষয় হচ্ছে, আল্লাহর সঙ্গে, তাঁর বিধিবিধানের সঙ্গে এবং রাসুলের সঙ্গে পরিচিতি লাভ।
এক ব্যক্তি অন্যকে যদি দ্বীনি এলেম শিক্ষা দেন, তবে সে ব্যক্তি নিজে আমল করবে এবং প্রত্যক্ষভাবেই হোক বা পরোক্ষভাবেই হোক পরবর্তী কাউকে না কাউকে শিক্ষা দেবে। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত এ সৎকাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।
হজরত মুহম্মদ (সা.) ওই ব্যক্তিকে সর্বাপেক্ষা বড় দাতারূপে আখ্যায়িত করেছেন, যিনি পবিত্র কোরআন সুন্নাহর এলেম অন্যদের শিক্ষা দেন। তার পরের স্থান মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্রাসা, রাস্তা ঘাট, সেতু পুকুর প্রভৃতি গণকল্যাণমূলক খাতে দান করা। এসবের দ্বারা অনেক বেশি লোক উপকৃত হন এবং উপকাটুকু দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়।
হজরত আবু হুরায়াহ (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল পাক (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি ব্যতীত, সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান অথবা সৎকর্মশীল সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম -১৬৩১)। ইমাম আন-নববী (রহ.) এই হাদিস খানার ওপর মন্তব্য করতে যেয়ে বলেছেন, ‘সদকায়ে জারিয়া হলো ওয়াকফ।’ (শরহে মুসলিম -১১/৮৫)।
পবিত্র কোরআনে দান সদকার কথা
অসংখ্য আয়াতে দান সদকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? (আল্লাহ বলেন,) জানিয়ে দিন, যা তোমাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত।’ (সুরা বাকারা : ২১৯)।
মহান আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না, সে ব্যক্তির মতো যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মতো যার ওপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিলো। তারা ওই বস্তুর কোনো সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।’ (সুরা বাকারা, ২৬৪)।
অপর আয়াতে বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজের মনকে সুদৃঢ় করার জন্য তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মতো, যাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়; অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত নাও হয়, তবে হাল্কা বর্ষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন।’ (সুরা বাকারা : ২৬৫)।
এছাড়াও সুরা আয্যারিয়াতের ১৯ নাম্বার আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদে নিঃস্ব ও অসহায়দের অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ আমরা যা দান করি, কোরআনের দৃষ্টিতে তা দয়া নয়; তা অসহায়দের অধিকার বা হক্কুল ইবাদ। আপনি যখন দান করেন, তখন আপনি সৃষ্টির অধিকারকেই সম্মান করেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করবেন।
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এবং তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে। ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত (অভাবী অথচ লজ্জায় কারও কাছে হাত পাতে না) সবার হক রয়েছে।’ (সুরা মাআরেজ : ২৪-২৫)।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক আরও এরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ হচ্ছে, সেই বীজের মতো যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। আর প্রতিটি শীষে একশতটি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ সুপ্রশস্ত সুবিজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা : ২৬১)।
হাদিসে দান সদকার কথা
অসংখ্য হাদিসেও দান-সদকার ফজিলত তুলে ধরা হয়েছে। গোপনে দান করার ব্যাপারে হাদিসে অধিক ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। গোপনে দানকারী কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে, নবী (সা.) বলেন, ‘কেয়ামত দিবসে সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। তাদের মধ্যে একশ্রেণি হচ্ছে, ‘এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে, বাম হাত জানতেই পারে না।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
দান-ছাদকা গোনাহ মাফ করে ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। নবী (সা.) বলেন, ‘হে কাব বিন উজরা! নামাজ (আল্লাহর) নৈকট্য দানকারী, রোজা ঢালস্বরূপ এবং দান-ছাদকা গোনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন- পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।’ (আবু ইয়ালা, সনদ সহিহ)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
বর্তমান যুগে অনেক মানুষ এমন আছে, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দান করে এবং তা মানুষকে দেখানোর জন্য। মানুষের ভালোবাসা নেওয়ার জন্য। মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য। মানুষের মাঝে গর্ব অহংকার প্রকাশ করার জন্য। অনেকে দুনিয়াবি স্বার্থসিদ্ধির জন্যও দান করে থাকে। যেমন, চেয়ারম্যান বা এমপি নির্বাচনে জেতার উদ্দেশ্য দান করে।
কিন্তু দান যদি একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হয় তা দ্বারা হয়তো দুনিয়াবি কিছু স্বার্থ হাসিল হতে পারে; কিন্তু আখেরাতে এর কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না। হাদিসে কুদসীতে নবী (সা.) বলেন, ‘আমি শিরক কারীদের শিরক থেকে মুক্ত। যে ব্যক্তি কোনো আমল করে তাতে আমার সঙ্গে অন্যকে শিরিক করবে, তাকে এবং তার শিরকির আমলকে আমি পরিত্যাগ করব।’ (মুসলিম)।
লোক দেখানো দান-সদকার শাস্তি
যারা মানুষের প্রশংসা নেওয়ার উদ্দেশ্যে দান করবে, তাদের দ্বারাই জাহান্নামের আগুনকে সর্বপ্রথম প্রজ্বলিত করা হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তিকে দিয়ে জাহান্নামের আগুনকে প্রজ্বলিত করা হবে।... তাদের মধ্যে (সর্ব প্রথম বিচার করা হবে) সেই ব্যক্তির, আল্লাহ যাকে প্রশস্ততা দান করেছিলেন, দান করেছিলেন বিভিন্ন ধরনের অর্থ-সম্পদ। তাকে সম্মুখে নিয়ে আসা হবে। অতঃপর (আল্লাহ) তাকে প্রদত্ত নেয়ামত পরিচয় করাবেন। সে তা চিনতে পারবে। তখন তিনি প্রশ্ন করবেন, কি কাজ করেছ এ নেয়ামতগুলো দ্বারা? সে জবাব দিবে, যে পথে অর্থ ব্যয় করলে আপনি খুশি হবেন, এ ধরনের সব পথে আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এরূপ করেছ এই উদ্দেশ্যে যে, তোমাকে বলা হবে, সে দানবির। আর তা তো বলাই হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে মুখের ওপর উপুড় করে টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম)।
কাদের দান করা যাবে?
কাদের দান করা যাবে এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে তাদের তালিকা দেওয়া হয়েছে। যথা, ‘জাকাত হলো শুধু ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য, এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তাওবা : ৬০)।
এ আয়াত দ্বারা ফকিহরা মোট আট শ্রেণির লোকদের দান করার কথা বলেছেন। (১) গরিব। যার সম্পদ আছে; কিন্তু নেসাব পরিমাণ মালের মালিক নয়। (২) মিসকিন। যার একদমই কোনো সম্পদ নেই। (৩) ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য শরিয়ত নির্দিষ্ট জাকাত আদায়কারী আমল। এটা ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা নিযুক্ত হতে হবে। নিজে নিজে মনে করে নিলে হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিক্বহ-৬/৬৯)। (৪) নব মুসলিমদের ইসলামের প্রতি মোহাব্বত বাড়ানোর জন্য উৎসাহমূলক জাকাত প্রদান। এ বিধানটি রহিত হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে কোনো ধনী নওমুসলিমকে জাকাত প্রদান জায়েজ নয়। (হিদায়া-১/১৮৪, মাআরিফুল কোরআন-৪/১৭১, তফসিরে মাজহারি-৪/২৩৫)। (৫) দাস মুক্তির জন্য। যেহেতু বর্তমানে দাসপ্রথা নেই। তাই এ খাতটি বাকি নেই। (৬) ঋণগ্রস্তের জন্য। (৭) ফী সাবিলিল্লাহ। তথা আল্লাহর রাস্তায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য। এখন প্রশ্ন হলো আল্লাহর রাস্তায় কারা আছে? ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেন, এতে রয়েছেন- জিহাদরত মুজাহিদরা। তাদের জিহাদের অস্ত্র ও পাথেয় ক্রয় করার জন্য জাকাতের টাকা গ্রহণ করবে। হজের সফরে থাকা দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। ইলমে দ্বীন অর্জনকারী দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। (আদ দুররুল মুখতার-৩৪৩, হিদায়া-১/১৮৫, রূহুল মাআনি-৬/৩১৩)। (৮) সফররত ব্যক্তিকে। যার টাকাণ্ডপয়সা আছে বাড়িতে। কোনো সফর অবস্থায় অসহায়। তাকে জাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ। মহান আল্লাহ আমাদের এ আলোচনার ওপর আমল করার তৌফিক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমিন।