কোরবানি করা একটি ধর্মীয় বিষয় ও ইবাদত। এই ইবাদত শুদ্ধ হওয়া বা না হওয়া নির্ভর করবে খোদ শরিয়তের সংশ্লিষ্ট ইবাদতবিষয়ক নিয়মবিধি, শর্তাবলী ও প্রক্রিয়া যথাযথ অবলম্বনের মাধ্যমে। এসব নিয়মবিধির মধ্যে পশুটি ক্রয়ের ক্ষেত্রে হাসিল-খাজনা পরিশোধ করার কথা উল্লেখ করা হয়নি। তাই সেটি কোরবানির মূল ইবাদতের মধ্যে পরিগণিত বা প্রতিবন্ধক নয়, বিধায় তা পরিশোধ না করায় কোরবানির কোনো ক্ষতি হবে না। কোরবানি যথা নিয়মে শুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়ানুগভাবে নির্ধারিত রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয় কর-খাজনা বা হাসিল পরিশোধ না করার কারণে সংশ্লিষ্ট কোরবানিদাতার পৃথক পাপ বা অপরাধ হতে পারে।
উল্লেখ্য, শরিয়া আইনের প্রামাণ্য গ্রন্থাদিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে জনগণের ওপর বিশেষত মুসলমানদের ওপর বিভিন্ন কর-শুল্ক ইত্যাদি আরোপ প্রশ্নে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আরও কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগির সম্পর্ক জড়িত এমন ক্ষেত্রে কর-শুল্কারোপ প্রশ্নে। উদাহরণত হজ একটি ইবাদত। এই ইবাদতে যাতায়াত প্রশ্নে বা যেকোনো পর্যায়ে কর-খাজনা আরোপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি ইহুদি-খ্রিষ্টানরা ইবাদত মনে করে, যদি বায়তুল মুকাদ্দাস যেতে চায়, তাদের কাছ থেকেও কর-খাজনা গ্রহণ বৈধ নয়। যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো অমুসলিম শাসক কর-খাজনা আরোপ করে থাকে, সেক্ষেত্রেও মুসলিম শাসকরা তাদের জনগণের ইবাদত সংশ্লিষ্ট খাতে তাদের প্রতি শুল্ক-করারোপ করবেন না।
আর অযৌক্তিক ও অন্যায্য বলতে উক্ত গ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে, ‘আয়কর ব্যতীত অপরাপর সব কর-শুল্ক তো বাছবিচার ছাড়াই ধনী-দরিদ্র সবার প্রতি আরোপ করা হয়। আবার আয়কর এর ক্ষেত্রে ‘আয়’-এর তো একটা মাত্রা আছে বটে অথচ সংশ্লিষ্টদের ‘ব্যয়’-এর প্রতি ভ্রুক্ষেপই করা হয় না।’ একইভাবে ‘সম্পদ’ এর কর সব সম্পদের মালিকের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক উসুল করা হয় অথচ তার মালিকের আয়ের কোনো উৎস আছে কি না তা বিবেচনায় নেওয়া হয় না কর নির্ধারণ বা কর আরোপের এমন পদ্ধতি সুস্পষ্ট অবিচার বলে গণ্য।’
কোনো কোনো সময় দেখা যায়, হাট থেকে পশু বিক্রয় হয়নি বলে বাড়িতে ফেরত নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে ক্রেতা পশু নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে ন্যায়ানুগ কর হতে বাঁচার জন্য এমন কৌশল অবলম্বনেও জাগতিক বিবেচনায় পাপ-অপরাধ হতে পারে; তবে কোরবানি সঠিকই থাকবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত হাসিলের হারের চেয়ে হাট কর্তৃপক্ষ অধিক হাসিল দাবি করে থাকে, যে কারণে ক্রেতাণ্ডবিক্রেতা উক্তরূপ কৌশল অবলম্বন করে। এ উভয় কর্ম তথা বেশি দাবি করা বা কৌশল অবলম্বন বৈধ কি না? এ ধরনের প্রশ্ন থেকেই অন্যায্য বাস্তবতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এমন অধিক হাসিল দাবি করা, যেমন পাপ-অপরাধ তেমনিই ন্যায্য ও যুক্তিসম্মত হাসিল প্রদান না করে, সামর্থ্যবানদের পক্ষে কৌশলের আশ্রয় গ্রহণও নৈতিক বিবেচনা ও রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। অবশ্য অন্যায্য করের ক্ষেত্রে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে তা পরিশোধ করা যেক্ষেত্রে কষ্টকর হয় সেক্ষেত্রে তেমন কৌশল অবলম্বনে পাপ হবে না মর্মে বিভিন্ন ফাতওয়ার কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মোট কথা, কোরবানির পশুটি যেহেতু একটা ধর্মীয় ইবাদত পালনে ক্রয় করা হচ্ছে, তাই যথাসাধ্য এক্ষেত্রে হাট কর্তৃপক্ষ বা সরকারকে সদয় ও সুদৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং ন্যূনতম যে অঙ্কের হাসিল-খাজনা নির্ধারণ করা হবে তারপক্ষে, সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহনের যৌক্তিকতা প্রচারের মাধ্যমে উৎসাহিত করে, হাসিল বা খাজনা গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
তথ্যসূত্র :
১. আদদুরুল মুখতার + শামী, খ—২, পৃষ্ঠা-৪৬৩-৪৬৪, এইচ এম সাঈদ এডুকেশন প্রেস, করাচি;
২. ইমদাদুল ফাতাওয়া, খ—৪, পৃষ্ঠা : ১৪০-, ১৬২, মাকতাবা দারুল উলুম, করাচি;
৩. ইমদাদুল ফাতাওয়া, খ—৩, পৃষ্ঠা : ১৬৯-১৭০, মাকতাবা দারুল উলুম, করাচি;
৪. আহসানুল ফাতাওয়া, খ—৮, পৃষ্ঠা-৯৮-৯৯, এইচ এম সাঈদ এডুকেশন প্রেস, করাচি;
৫. আজিযুল ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা-৭৫৮, দারুল ইশাআত, করাচি।
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ