ব্যবসা-বাণিজ্য মানব জীবনের প্রয়োজনীয় এক অধ্যায়। জীবনের বহুবিধ প্রয়োজনের সব কিছুই একজনের পক্ষে নিজে উৎপাদন করা সম্ভব নয় বিধায় পরস্পরের প্রয়োজন পূরণের তাগিদেই ব্যবসার পথে অগ্রসর হতে হয়। বস্তুত ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন-জীবিকা লাভের অন্যতম এক উপায়। মহান আল্লাহতায়ালা এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য নামাজ সমাপনান্তে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়তে মোমিনদের নির্দেশ দিয়েছেন। (সুরা জুম‘আ : ১০)। রাসুল (সা.) যেমন নিজে ব্যবসা করেছেন, তেমন এর গুরুত্ব বুঝাতে ইরশাদ করেছেন : সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীরা কেয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে। (তিরমিজি : ১২০৯)।
তবে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তি রেখেছে পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর। তাই প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে এ ধরনের মন-মানসিকতা থাকা একান্ত জরুরি। তাহলেই এ সম্পর্কিত বিধিবিধান এবং নীতিমালা মেনে নেওয়া সহজ হয়। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি বিষয়ের বিধিবিধান জেনে নেওয়া যেমন ফরজ, তেমনি ব্যবসার মাসআলা-মাসাইল জেনে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করাও আবশ্যক। এ ফরজের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করলে হারাম এবং সুদী কারবারে জড়িত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বেচা-কেনার সংজ্ঞা
বেচা-কেনা, ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা ও তিজারত এগুলো সমার্থক শব্দ। সাধারণ অর্থে লাভের আশায় বৈধ পণ্যের লেনদেনকে ব্যবসা ও তিজারত বলা হয়। যেমন ফিকহের কিতাবে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দুই পক্ষের পূর্ণ সম্মতিক্রমে মুদ্রা কিংবা বৈধ পণ্যের বিনিময়ে বৈধ পণ্যের হস্তান্তরকে ইসলামী শরিয়তে বেচা-কেনা বলে। (হিদায়া-টিকা : ৩/১৮)। সুতরাং, বেচাকেনা শরিয়তসম্মত উপায়ে সংঘটিত হওয়ার জন্য মোট ৩টি জিনিষ পাওয়া যেতে হবে।
১. বৈধ মাল হতে হবে : বৈধ মাল না হলে তা বিক্রি করা বা খরিদ করা জায়েজ হবে না। যেমন- শুকর, রক্ত, মদ, গান-বাদ্যের যন্ত্র, সিনেমার বা নৃত্য অনুষ্ঠানের টিকিট ইত্যাদি। এগুলো শরিয়তের দৃষ্টিতে মাল নয়, তাই এগুলোর ক্রয়-বিক্রয় হারাম।
২. পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হতে হবে : দোকানদার ক্রেতাকে বললো, এটা নগদ নিলে এত দাম, আর বাকি নিলে এত দাম। এখন যদি ক্রেতা শুধু বলে ঠিক আছে। কিন্তু উভয়টির কোনটা, নির্দিষ্ট করল না। তাহলে এ বেচাকেনা জায়েজ হবে না; বরং এটা সুদি কারবারের অন্তর্ভুক্ত হবে।
৩. উভয়পক্ষ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি পাওয়া যেতে হবে : অনেকে গায়ের জোরে নির্ধারিত মূল্য থেকে কম মূল্যে জিনিস ক্রয় করে, এটা হালাল হবে না। অনেক সময় একতরফা মূল্য নির্ধারিত করা হয়। যার প্রতি অন্য পক্ষের সম্মতি থাকে না। এটাও জায়েজ নেই।
বেচাকেনার প্রকারভেদ
বেচাকেনা মোট চার প্রকার। যথা : ১. পণ্যের বিনিময়ে পণ্য (বাইয়ে মুকায়াযাহ), ২. মুদ্রার বিনিময়ে পণ্য (সাধারণ বিক্রি), ৩. মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা (বাইয়ে সরফ), ৪. নগদ মুদ্রার বিনিময়ে বাকি পণ্য ক্রয় (বাইয়ে সালাম)।
শরীই হুকুম :
প্রথম প্রকারে যদি উভয়টির জিনিস তথা জাত এবং ক্বাদর তথা পরিমাপ পদ্ধতির দিক দিয়ে এক হয়। যেমন- ধানের বিনিময়ে ধান বিক্রি করা, তাহলে নগদা-নগদি বিক্রি করতে হবে এবং উভয়ের মধ্যে পরিমাণের দিক দিয়ে সমতা রক্ষা করতে হবে। নতুবা জায়েজ হবে না। আর যদি উভয় দিক দিয়ে ভিন্ন হয় অর্থাৎ, উভয়টির জাত ভিন্ন এবং পরিমাপ পদ্ধতিও ভিন্ন হয় যেমন- ধানের বিনিময়ে পাট বিক্রি করা- তাহলে পরিমাণে কমবেশি করে বিক্রিও জায়েজ হবে এবং বাকিতে বিক্রিও জায়েজ হবে। আর যদি উভয় দিকের একদিক দিয়ে ভিন্ন হয়, অপরদিক দিয়ে এক হয়- যেমন : ধান এবং গম উভয়টির জাত ভিন্ন; কিন্তু পরিমাপ পদ্ধতি অভিন্ন- তাহলে কমবেশিতে বিক্রি জায়েজ হবে। কিন্তু বাকিতে বিক্রি করা জায়েজ হবে না।
আর দ্বিতীয় প্রকারে (সাধারণ বিক্রিতে) নগদণ্ডবাকি উভয়ভাবেই বিক্রি জায়েজ। তৃতীয় প্রকারে (মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রার বিক্রয়) উভয়টি এক দেশি হলে কমবেশি এবং বাকি কোনোটিই জায়েজ নেই। (হিদায়া : ৩/৭৯)।
আর চতুর্থ প্রকারে তথা বাইয়ে সালাম শুদ্ধ হওয়ার জন্য কতগুলো শর্ত আছে। যেমন : ক. নগদ কত টাকার বিনিময়ে কি পণ্য দেওয়া হবে, তার জাত নির্ণয় করা। খ. উক্ত পণ্যের প্রকার বা ধরন বর্ণনা করা। গ. গুণাগুণ বর্ণনা করা। অর্থাৎ, উন্নতমানের না মাঝারী ধরনের কিংবা নিম্নমানের পণ্য হবে তা বর্ণনা করা। ঘ. মালের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা। ঙ. পণ্য কোন দিন, কোন সময়, কোথায় হস্তান্তর করা হবে তা নির্দিষ্ট করা। চ. যে পণ্যে বাইয়ে সালাম হবে, সে মালটি লেনদেনের দিন থেকে পরিশোধের দিন পর্যন্ত বাজারে মজুত থাকা। উল্লেখিত শর্তগুলো পাওয়া গেলে বাইয়ে সালাম জায়েজ হবে। অন্যথায় নয় এবং এই শর্তগুলো চুক্তিনামার মধ্যে লিখিত থাকতে হবে। (হিদায়া : ৩/৯৫)
বেচা-কেনার মূলনীতি
১. লেনদেনকারীদের মধ্যে অবশ্যই লেনদেনের যোগ্যতা থাকতে হবে। অর্থাৎ, তাদের প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক না হলেও লেনদেনের বুঝ রাখে এমন সুস্থ মস্তিস্ক, স্বাধীন ব্যক্তি হতে হবে। (দুররে মুখতার : ৪/৫০৪)।
২. ক্রয়-বিক্রিয়ের জন্য নির্বাচিত পণ্যের মাঝে অবশ্যেই পণ্য হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। পণ্য হওয়ার যোগ্য না হওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন- ক. দ্রব্যটি বেশি সম্মানিত হওয়া, যেমন- মানুষ এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। খ. বেশি ঘৃণ্য হওয়া। যেমন শুকর ইত্যাদি। গ. শরীয়ত কর্তৃক তার ভোগ ব্যবহার হারাম হওয়া। যেমন- শরাব, মাদকদ্রব্য, মৃত প্রাণী ইত্যাদি। (দুররে মুখতার : ৪/৫০৬)।
৩. পণ্য হস্তান্তরযোগ্য হতে হবে। সুতরাং, আকাশে উড়ন্ত পাখি বিক্রি করা এবং নদী বা পুকুরের পানির ভেতরে মাছ বিক্রি করা জায়েজ নেই। (হিদায়া : ৩/৫১)।
৪. বিক্রেতার কাছে পণ্য উপস্থিত থাকতে হবে। সুতরাং বর্তমানে যে বিদেশ থেকে মাল আমদানি করে তা আনার আগেই উক্ত মালের ডকুমেন্ট বিক্রি করে দেয় এবং ক্রেতা আবার আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। এভাবে মাল আসার আগেই কয়েকবার বিক্রি হয়ে যায় এটা জায়েজ নেই। (হিদায়া : ৩/৫১)।
৫. পণ্যের ওপর বিক্রেতার মালিকানা থাকতে হবে। (হিদায়া : ৩/৫১)।
৬. উক্ত মাল হারাম উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্ট না হতে হবে। যেমন- টিভি, ভিসিআর, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি। (হেদায়া : ৪/৫৪)।
৭. মালের মূল্য নির্ধারিত হতে হবে। মূল্য অস্পষ্ট থাকলে বেচাকেনা বৈধ হবে না। যেমন বলল : এ মালটা নিয়ে যান ইনসাফ করে দাম দিয়ে দিবেন। কেন না, এ ধরনের অস্পষ্টতা পরিণামে আত্মকলহ ও ঝগড়া-বিবাদের কারণ হয়। (হিদায়া : ৩/৫৪)।
৮. বেচাকেনার চুক্তিতে এমন কোনো শর্তজুড়ে দেওয়া যাবে না, যা উক্ত পণ্যের বেচাকেনার চুক্তির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সংশ্লিষ্ট নয়। যেমন- বর্তমানে ‘মাল্টিলেভেল মার্কেটিং’ ব্যবসার মধ্যে দালালি শর্ত করা হয়। অথবা বলা হলো যে, বাড়িটি বিক্রি করলাম; কিন্তু এক মাস আমাকে থাকতে দিতে হবে। কিংবা বলা হলো যে, আমাদের থেকে এত টাকার মাল কিনতে হবে এবং আরও দুজন গ্রাহক সংগ্রহ করতে হবে। (হিদায়া : ৩/৫৯)।
৯. এমন কোনো চুক্তি ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়, যেখানে একপক্ষের নিশ্চিত লাভের ও অপর পক্ষের নিশ্চিত ক্ষতির শর্ত সংশ্লিষ্ট থাকে। যেমন : জুয়া, হাউজি, লটারি ইত্যাদি। (হিদায়া : ৩/৫৪)।
১০. বেচাকেনায় কোনোরূপ ধোঁকা, প্রতারণা, জালিয়াতি, ফটকাবাজি ও ভেজাল থাকতে পারবে না এবং এমন কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না, যার দ্বারা সাধারণ ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (হিদায়া : ৩/৫২)।
১১. যে মাল জমা রাখলে জনগণের কষ্ট হয়, তা জমা রাখা জায়েজ নেই। শরিয়াতের পরিভাষায় একে ইহতেকার বা মজুতদারি বলে। (হিদায়া : ৪/৪৬৮)।
এছাড়া আরও অনেক নীতিগত বিষয় আছে যা বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নেওয়া আবশ্যক। উল্লেখিত, নীতিমালার আলোকে ব্যবসার নামে অবাধ শোষণ, অন্যায় আত্মসাৎ, দ্রব্যে ভেজাল, মাপে কম দেওয়া, ধোঁকাণ্ডপ্রতারণার মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জন, মজুতদারি ও কালো বাজারির মাধ্যমে বাড়তি মূল্য আদায় বা পর্যাপ্ত মাল থাকা সত্ত্বেও তা আটকে রেখে বাজার মূল্য বৃদ্ধি করা, কিংবা কাউকে বেকায়দায় ফেলে ক্রয়-বিক্রয়ে বাধ্য করা, অথবা কারও বিপদের সুযোগে তার থেকে অধিক হারে লাভবান হওয়ার মানসে ক্রয়-বিক্রয় করা, পণ্যের উপর একচেটিয়া দখল সৃষ্টি করে, বাড়তি মূল্যে বিক্রি করা ইত্যাদি ধরনের বেচাকেনা শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ, অবৈধ ও হারাম এবং এর দ্বারা উপার্জিত অর্থও হালাল নয়। এধরনের অর্থ দ্বারা হজ ও ওমরা করা, মসজিদণ্ডমাদ্রাসা নির্মাণ করা এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করার দ্বারা উক্ত হারাম পয়সার দায় থেকে আল্লাহর দরবারে রেহাই পাওয়া যাবে না। বরং এর জন্য হক্কানী মুফতিদের কাছে থেকে শরীয়তের বিধান জেনে সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এবং খালিস দিলে তওবা-ইস্তেগফার করলে আল্লাহতায়ালার আজাব থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা করা যায়।
বেচাকেনার প্রচলিত কয়েকটি পদ্ধতি এবং তার শরিয়া বিধান
১. বীজ ধানের বিক্রি : আমাদের সমাজে সাধারণ ধান দিয়ে বীজ ধান নেওয়া হয় কমবেশি করে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা নাজায়েজ। এর থেকে বাঁচার উপায় হলো, প্রথমে টাকা দিয়ে বীজ ধান কিনবে। এরপর বীজ ধানের বিক্রেতা ওই টাকা দিয়ে সাধারণ ধান কিনবে। (হিদায়া : ৩/১০৪)।
২. আর একটা ব্যবসা হলো- টাকাণ্ডপয়সার বেচাকেনা, টাকা ভাঙানো, ছেড়া টাকা দিয়ে ভালো টাকা নেওয়া। এগুলোকে বাইউস? সরফ বলে। এখানে সাধারণভাবে কমবেশি করা জায়েজ নেই এবং কোনো পক্ষ বাকি রেখে লেনদেন করাও জায়েজ নেই। প্রয়োজনে করজ নেওয়া যাবে। উদাহরণ স্বরূপ ৫০০ টাকার খুচরা করার প্রয়োজন। কিন্তু অপর পক্ষের কাছে ওই পরিমাণ খুচরা নেই। বরং ৩০০ টাকার খুচরা আছে। তখন খুচরা হিসাবে ৩০০ টাকা রাখবে। পরে এক সময় ওই ৩০০ টাকার করজ পরিশোধ করে আমানতের ৫০০ টাকা নিয়ে আসবে। (হিদায়া : ৩/১০৪)।
৩. গ্রাম থেকে আগত ব্যক্তির কাছ থেকে কম দামে মাল ক্রয় করে, শহরের লোকদের কাছে অতিবেশী দামে বিক্রি করা। এর দরুন যদি গ্রামের বিক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথবা শহরের লোকদের কষ্ট হয়। এটাও নাজায়েজ। (হিদায়া : ৩/৬৭)।
৪. শহরের ব্যবসায়ী গ্রামের ব্যবসায়ীর দালাল হয়ে তার মাল শহরের লোকদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা। এটাও নাজায়েজ। (হিদায়া : ৩/৬৭)।