ঢাকা সোমবার, ১৮ আগস্ট ২০২৫, ৩ ভাদ্র ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সিকিউরিটি মানি ও অ্যাডভান্সের বিধান

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব
সিকিউরিটি মানি ও অ্যাডভান্সের বিধান

সিকিউরিটি মানি ও অ্যাডভান্স বর্তমান সময়ের ব্যাপক পরিচিত দুটি লেনদেন। বিশেষ করে, বাড়ি ও দোকান ভাড়ার ক্ষেত্রে এসব লেনদেন মানুষ বেশি করে থাকে। ভাড়াটিয়া ভাড়া শেষে চলে গেলে কোনো ক্ষতি করে গেলে, সে টাকা থেকে তা পুষিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই মূলত এ ধরনের অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা হয়। তবে এ ধরনের লেনদেনে শরয়ি বিশ্লেষণ জানা না থাকায় বেশকিছু ভুল হয়ে থাকে।

সিকিউরিটি মানি ও অ্যাডভান্স কী?

জামানত হিসেবে ভাড়া গ্রহীতা থেকে যে টাকা গ্রহণ করে ভাড়ার চুক্তি শেষে তা আবার ভাড়া গ্রহীতাকে ফেরত দিতে হয়, তাকে সিকিউরিটি মানি বলে। আর এককালীন গ্রহণ করা টাকা প্রতি মাসেই কিছু কিছু করে ভাড়া হিসেবে কাটাকে অ্যাডভান্স সিকিউরিটি মানি বলে। ভাড়াদাতার কাছে থাকলেও এর মালিকানা থাকে ভাড়াটিয়ার। ভাড়াটিয়া পরবর্তীতে ওই টাকা ফেরত পায়। সুতরাং সিকিউরিটি মানির জাকাত ভাড়াটিয়া প্রদান করবে। অন্যদিকে অ্যাডভান্স হিসেবে প্রদানকৃত টাকার মালিকানা ভাড়াটিয়া থেকে ভাড়াদাতার কাছে চলে যায়।

সিকিউরিটি ও অ্যাডভান্সের ভাড়া

সিকিউরিটি মানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ভাড়া কমে যাওয়ার যে প্রচলন আমাদের সমাজে রয়েছে, তা জায়েজ নয়। কেননা, সিকিউরিটি মানি ভাড়াদাতার কাছে ঋণ হিসেবে থাকে। তাই এ টাকার কারণে ভাড়ার পরিমাণ কমিয়ে দিলে তা ঋণ দিয়ে ঋণগ্রহীতা থেকে অতিরিক্ত সুবিধা গ্রহণের অন্তর্ভুক্ত; যা সুদ ও হারাম। (আস সুনানুল কোবরা লিল বায়হাকি : ৫/৫৭৩, আল মাবসুত লিস সারাখসি : ১৪/৩৫)। তবে সিকিউরিটি মানি না হয়ে যদি অ্যাডভান্স তথা অগ্রিম ভাড়া প্রদান করার কারণে ভাড়া কিছুটা কমানো হয়, তাহলে তাতে সমস্যা নেই। কেননা, অ্যাডভান্সের টাকা ভাড়াদাতার কাছে ঋণ হিসেবে থাকে না। ফলে ভাড়া কমানো হলেও তা ঋণের পরিবর্তে কমানো হয়েছে বলে গণ্য হয় না। যেমন- একটি ফ্ল্যাটের জন্য ৫০ হাজার টাকা সিকিউরিটি মানি প্রদান করলে ভাড়া হবে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু সিকিউরিটি হিসেবে ২ লাখ টাকা অগ্রিম দিলে ভাড়া হয়ে যাবে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। সিকিউরিটি মানি তথা ফেরতযোগ্য ঋণ বৃদ্ধির কারণে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার ভাড়া ৩ থেকে ৪ হাজারে নেমে এসেছে। এটি সুদের অন্তর্ভুক্ত। ফাজালা বিন উবাইদ (রা.) বলেন, ‘যে ঋণ কোনো মুনাফা নিয়ে আসে, তা রিবার অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে বায়হাকি : ৫/৩৫০)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বস্তু ঋণ দেবে, সে যেন অতিরিক্তি কিছু গ্রহণের শর্ত না করে; যদিও তা একমুঠো ঘাস হোক না কেন।’ (মুয়াত্তায়ে মালেক : ২৫১৩)। তবে অ্যাডভান্সের ব্যাপারটি ভিন্ন।

অ্যাডভান্সের বিপরীতে ভাড়া কমানোর সুযোগ রয়েছে। কেননা, তা ঋণ হিসেবে থাকে না; বরং অগ্রিম প্রদেয় ভাড়া। মোটকথা, সিকিউরিটি মানি বৃদ্ধির কারণে ভাড়ার স্বাভাবিক হার থেকে কমানো জায়েজ নয়। কিন্তু অ্যাডভান্সে জায়েজ আছে।

সিকিউরিটি মানির জাকাত

সিকিউরিটি মানি ভাড়াদাতার কাছে থাকলেও এর মালিকানা থাকে ভাড়াটিয়ার। তাই ভাড়াটিয়া পরবর্তীতে ওই টাকা ফেরত পায়। সুতরাং সিকিউরিটি মানির জাকাত ভাড়াটিয়া প্রদান করবে। অন্যদিকে অ্যাডভান্স হিসেবে প্রদানকৃত টাকার মালিকানা ভাড়াটিয়া থেকে ভাড়াদাতার কাছে চলে যায়। তাই এ টাকা পরবর্তীতে ফেরত দিতে হয় না। সুতরাং অ্যাডভান্স হিসেবে নেওয়া টাকার জাকাত ভাড়াদাতার ওপর আবশ্যক হবে। (জাদিদ ফিকহি মাসায়েল : ১/১৪৭-১৪৮, মালে হারাম আওর উসকে মাসারেফ ওয়া আহকাম : ৮৫)। আর যদি টাকাটা শুধু জামানত হিসেবে বা ঋণ হিসেবে দোকান ও বাড়ির মালিকের কাছে গচ্ছিত রাখা হয়, এ ক্ষেত্রে মূল মালিক যেহেতু যিনি দোকান বা বাসা ভাড়া নিয়েছেন তিনিই থাকেন, তাই ওই টাকার জাকাত দোকান বা বাসা ভাড়াকারী ব্যক্তি তথা টাকা জমাদাতা ব্যক্তির ওপরই আসবে।

বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার জন্য সিকিউরিটি বাবদ কিছু টাকা প্রদান করতে হয়। এ টাকাটা প্রদানকারীর মালিকানায় থাকে। প্রতিষ্ঠান শুধু টাকাটা সংরক্ষণ করে থাকে সিকিউরিটি বাবদ। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে প্রতিষ্ঠান ওই টাকা ফেরত দেয়। ওই টাকার জাকাত প্রদানকারী আদায় করবে, গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান আদায় করবে না। অনুরূপভাবে ব্যাংকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিকিউরিটি হিসেবে গ্যারান্টি মানি প্রদান করতে হয়। ওই টাকা অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের মালিকানাধীন থাকে। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে তিনি ওই টাকা উত্তোলন করতে পারেন। ওই টাকাও জাকাতযোগ্য। এ টাকার জাকাতও প্রদানকারী আদায় করবে।

সিকিউরিটি মানির শরয়ি বিধান

সিকিউরিটি মানি তথা জামানত হিসেবে যে অর্থ ভাড়াদাতাকে প্রদান করা হয়, পরবর্তীতে তা আবার প্রদানকারীকে ফেরত দেওয়া হয়, তা ভাড়াদাতার কাছে বন্ধক হিসেবে থাকে। আর বন্ধকী বস্তু যেহেতু ব্যবহার করা নাজায়েজ ও সুদের অন্তর্ভুক্ত, তাই এ টাকাও ব্যবহার করা সুদ হবে। মুহাম্মদ ইবনে সিরিন (রহ.) সূত্রে বর্ণিত আছে; তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘আমার কাছে এক ব্যক্তি একটি ঘোড়া বন্ধক রেখেছে। আমি এতে আরোহণ করেছি। এর কী হুকুম?’ তখন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, ‘তুমি এর পিঠ থেকে (আরোহণ করে) যে উপকৃত হয়েছ, তা সুদের অন্তর্ভুক্ত।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ১৫০৭১)। তবে এ ক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে। সিকিউরিটির টাকা ভাড়াগ্রহীতা থেকে ঋণ হিসেবে নিলে তা ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু তখন এ সিকিউরিটি মানির কারণে ভাড়া কমানো যাবে না। কেননা, ঋণ নিয়ে কোনো সুবিধা দিলে তা সুদ হিসেবে গণ্য হয়। সিকিউরিটির টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়ার জন্য আরও একটি শর্ত রয়েছে। ঋণের চুক্তিটি ভাড়া গ্রহণের সময় করতে পারবে না, বরং পরে করতে হবে। ভাড়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারবে না। কেননা, একটি চুক্তির সঙ্গে আরেকটি চুক্তি শর্তযুক্ত করে কারবার করা নাজায়েজ। এটিকে ‘সাফকাতাইনে ফি সাফকাহ’ কিংবা ‘বাইআতাইনে ফি বাইআহ’ বলা হয়। হাদিস শরিফে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হলো, ভাড়াদাতা ভাড়াগ্রহীতা থেকে এককালীন যে টাকাটা নেবে, তা অ্যাডভান্স তথা অগ্রিম ভাড়া হিসেবে নেবে; যা চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া হিসেবে কর্তিত হবে। এতে দোকান বা বাড়ির মালিক একত্রে বেশি টাকাও নিতে পারে এবং তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধও হবে। (মুসনাদে আহমদ : ৬৬২৮, শরহুল মাজাল্লাহ, খালিদ আতাসি : ৩/১৪৫, ১৯৬)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত