ইসলামে ব্যবসায় ও নৈতিকতা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। একজন মুসলমান হিসেবে নৈতিকতা কেবল আমাদের ব্যবসায়ী জীবনেই পরিব্যপ্ত নয়; বরং আমাদের গোটা জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এর নিগূঢ় কার্যকারিতা রয়েছে। ব্যবসায় নৈতিকতা বলতে আমরা যে বিষয়টি বুঝি তা হলো, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ভালো ও কল্যাণকর নীতি, যা মানুষের অভীষ্ট অধিকারকে নিশ্চিত করবে এবং অকল্যাণকর যাবতীয় বিষয় থেকে মানুষের স্বার্থরক্ষা করবে। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের বেলায় কতগুলো শুভ নৈতিক বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অশুভ ও অনৈতিক কাজকে পরিহার করতে উৎসাহ দিয়েছেন এবং এর মধ্যে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও মুক্তি নিহিত বলে উল্লেখ করেছেন।
নিয়তকে বিশুদ্ধ করা : মানুষ পার্থিব স্বার্থ লাভ কিংবা প্রশংসা ও সুনাম অর্জন বা নিন্দার ভয়েও অনেক আমল করে থাকে। অন্তরকে এ সব উদ্দেশ্য থেকে পবিত্র ও মুক্ত করে শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করাকে ইখলাস বলা হয়। একজন মোমিনের কাছে তাঁর ঈমানের দাবি হলো, তার জীবনের প্রতিটি কাজের পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য থাকতে হবে এবং নিয়তের বিশুদ্ধতার মাধ্যমে তার সব কাজই আল্লাহর ইবাদতে পরিণত হবে। এজন্য ব্যবসায়ী যখন ব্যবসা শুরু করবে সর্বপ্রথম তার নিয়তকে এভাবে বিশুদ্ধ করে নেবে যে, সে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন এবং হালাল উপার্জনের নিমিত্ত হিসেবে তা গ্রহণ করবে। নিয়তের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমলগুলো (অর্থাৎ এগুলোর ফলাফল কিংবা বিশুদ্ধতা) একান্তই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বোখারি : ১)
ক্রয়-বিক্রয়ের প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করা : ব্যবসার ক্ষেত্রে নৈতিকতার আরেকটি দিক হলো, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করা, যাতে কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কারণ ইসলামের মূলনীতি হলো, ‘কারও ক্ষতি করা যাবে না এবং কারও ক্ষতির শিকারও হওয়া যাবে না।’ (ইবনে মাজাহ : ২৩৪০, ২৩৪১)।
এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, উমর (রা.) বাজার পরিদর্শন করতেন, তার হাতে একটি বেত থাকত। কাউকে অন্যায় কিছু করতে দেখলে তিনি বেত দিয়ে শাসাতেন এবং বলতেন, ‘আমাদের বাজারে তারাই বেচাকেনা করবে, যাদের এ বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে। অন্যথায় ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সুদে জড়িয়ে পড়বে।’ (তিরমিজি : ৪৮৭)।
অনুরূপভাবে আলী (রা.) বলেছেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করার আগে যে ব্যক্তি ব্যবসা শুরু করবে, সে সুদে জড়িত হলো, সে সুদে জড়িত হল, সে সুদে জড়িত হল।’ (ইবনে কুদামা, আল-মুগরি, ২/২২)।
সকাল সকাল ব্যবসার উদ্দেশ্যে বের হওয়া : সকাল সকাল ব্যবসার উদ্দেশ্যে বের হওয়া। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতের সকালসমূহের বরকতের জন্য দোয়া করেছেন। যেমন হজরত সখর আল-গামিদী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতের সকালসমূহে বরকত দান করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন যুদ্ধ উপলক্ষে সৈন্য প্রেরণের ইচ্ছা করতেন, দিনের প্রথমাংশেই পাঠাতেন। বলা হয়, সখর ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ব্যক্তি। তিনি তার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের দিনের প্রথমভাগে ব্যবসায়ে পাঠাতেন। এতে তিনি ধনী হয়েছিলেন এবং তার সম্পদও বৃদ্ধি পেয়েছিল। (আবু দাউদ : ২২৩৯)।
বাজারে প্রবেশ করার সময় আল্লাহকে স্মরণ করা : ইসলামে আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম হলো, সর্বক্ষণ ও সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার কথা স্মরণ রাখবে এবং প্রতিটি চিন্তা, কথা ও কাজে তাঁর আদেশ-নিষেধ ও পছন্দ-অপছন্দের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় নানাভাবে তার কথা স্মরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করো।’ (সুরা আহযাব : ৪১)।
তাই একজন ব্যবসায়ীর কর্তব্য হবে, সে যখন বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে তখন থেকে আল্লাহর জিকির তথা স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে হজরত উমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ দোয়া পড়ে বাজারে প্রবেশ করল, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। সব রাজত্ব তার তত্ত্বাবধানে। তিনিই সমস্ত প্রশংসার মালিক। তিনি জীবন্তকারী এবং মৃত্যুদানকারী। তিনি চিরঞ্জীব। তার হাতেই যাবতীয় কল্যাণ। তিনি সব ক্ষমতার অধিকারী। আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় লাখ লাখ নেকীদান করবেন, লাখ লাখ পাপ ক্ষমা করে দেবেন এবং লাখ লাখ মর্যাদা বুলন্দ করবেন।’ (তিরমিজি : ৩৩৫০)।
আল্লামা তিবী (রহ.) বলেন, ‘এখানে জিকিরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো, মানুষ ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে পড়লে আল্লাহকে ভুলে যায়। তাছাড়া বাজার হলো শয়তান ও তার দোসরদের আবাসস্থল। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করল, সে যেন প্রকান্তরে শয়তানে সঙ্গে যুদ্ধ করল এবং তার দোসরদের পরাজিত করে সওয়াবের ভাগী হলো।’
লেনদেনে উদারতা ও কোমলতা প্রকাশ করা : ব্যবসায়ে নৈতিকতা ও উত্তম শিষ্টাচার হলো, লেনদেনের ক্ষেত্রে উদারতা ও কোমলতা প্রকাশ করা, সর্বোচ্চ চারিত্রিক গুণাবলি প্রকাশ করা, কোনো দাবি আদায় করতে সাধারণ জনগণের ওপর কোনো রকম সংকীর্ণতা, কষ্ট বা সঙ্কট চাপিয়ে না দেওয়া ইত্যাদি। ইসলাম সদা-সর্বদা সহজ-সরল কর্মকা- পরিচালনায় মানুষকে উৎসাহিত করেছে। ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরের সঙ্গে ভালো ও কোমল আচরণের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তির ওপর রহমত করেন, যে ক্রয়-ক্রিয়ের সময় এবং নিজের হক আদায়ের সময় কোমল আচরণ করে।’ (সহিহ বোখারি : ২০৭৬)।
তাছাড়া কোনো অভাবগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্তকে কেউ যদি সময় এবং সুযোগ দেয় তাহলে তার রয়েছে অনেক সওয়াব। অপর হাদিসে তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির একজন লোককে আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, যে বেচাকেনার সময় এবং পাওনা মিটানোর সময় সহজতা অবলম্বন করত।’ (তিরমিজি : ১২৪১)
ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সরলতা ও সততা প্রদর্শনকারীর জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সুসংবাদ প্রদান করে বলেছেন, ‘ক্রয়-বিক্রয়ে যে লোক সহজ-সরল নীতি অবলম্বন করে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (ইবনে মাজাহ : ২২০২)।
ব্যবসায় পণ্য থেকে কিছু দান-সদকা করা
ব্যবসায় পণ্য থেকে কিছু দান-সদকাহ করা। যাতে তা ব্যবসার ক্ষেত্রে মনের অজান্তে ঘটে যাওয়া ছোটখাটো অপরাধের মার্জনাকারী হয়। এজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়! লেনদেনের সময় শয়তান ও গোনাহ এসে উপস্থিত হয়। অতএব, তোমরা ব্যবসায়ের সঙ্গে দান-সদকাহও যুক্ত করো। কারণ, এ দান-সদকাহ্ প্রতিপালকের রাগকে প্রশমিত করে।’ (তিরমিজি : ১১২৯)।
অন্যত্র রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়! ক্রয়-বিক্রয়কালে শপথ ও বেহুদা কথাবার্তা হয়ে যায়, তাই কিছু দান খয়রাত করে তা ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে নাও।’ (নাসায়ি : ৪৩৮৭)।
চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা
ইসলামে অঙ্গীকার রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। অঙ্গীকার রক্ষা করা একজন সৎ ব্যবসায়ীর অন্যতম কর্তব্য। একজন ভালো ব্যবসায়ী কখনোই তার প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর।’ (সুরা মায়িদা : ১)।
অপর আয়াতে তিনি আর বলেন, ‘অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৪)।
এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে না, দ্বীন ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৩৬৩৭)।
অন্য একটি হাদিসে ওয়াদা ও চুক্তি ভঙ্গ করাকে মোনাফিকের একটি প্রধান আলামত ও লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মোনাফিকের লক্ষণ হলো তিনটি। এগুলো হলো, এক. সে যখন কথা বলে মিথ্যা বলেন। দুই. যখন সে ওয়াদা ও চুক্তি করে ভঙ্গ করে। তিন. যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তা খিয়ানত করে।’ (সহিহ বোখারি : ২২০)।
ইসলামি অর্থব্যবস্থায় হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যাবতীয় অন্যায় ও অনৈতিক কার্যাবলি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামের এসব দিকনির্দেশনা অবলম্বনের মাধ্যমেই শোষণ-বঞ্চিত ও সুখী-সমৃদ্ধ একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।