ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মৃতের প্রতি অবজ্ঞা নয়

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
মৃতের প্রতি অবজ্ঞা নয়

মৃত্যু একটি চিরন্তন সত্য বিষয়। সব প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে মানুষ মহান আল্লাহর মর্যাদাপূর্ণ ও সর্বোত্তম সৃষ্টি। জীবিত একজন মানুষ যেভাবে সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য, ঠিক তেমনি মৃত ব্যক্তিও সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। জীবিত মানুষের মনে ও শরীরে যেমন আঘাত দেওয়া নিষেধ, ঠিক তেমনি মৃতের মন ও শরীর আঘাত পায়Ñ এমন আচরণও নিষেধ। শ্রদ্ধার সঙ্গেই মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্য সমাধা করতে হয়। গোসল, পরিচ্ছন্ন কাফন, সুগন্ধি মাখানো, জানাজার মাধ্যমে চিরবিদায় জানিয়ে সম্মানের সঙ্গে কবরস্থ (দাফন) করা এসব কিছুই মৃতের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ আচরণেরই অংশ।

এছাড়া আজীবন তাকে দোয়ার মাধ্যমে স্মরণ রাখা এবং কবর জিয়ারত করার বিধানও ইসলামে রয়েছে।

আত্মীয়, প্রতিবেশী, সমাজ বা অন্য কারও পক্ষ থেকে মৃতের প্রতি অমর্যাদাকর আচরণ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এমনটি সীমাহীন অমানবিকও বটে। মৃতের প্রতি করণীয় ইসলামের বিধানগুলোতে মৃতের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধই ফুটে ওঠে।

মৃত্যু সংবাদ শুনে ‘ইন্নালিল্লাহি’ পড়া

মানুষের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর সংবাদ হলোÑ কারও মৃত্যুর খরব শোনা। কিন্তু নির্মম সত্য হলোÑ আমাদের প্রতিদিন এ দুঃসংবাদ শুনতে হয়। বিপদ যেন মানুষকে অপ্রকৃতিস্থ করতে না পারে, সেজন্য মহান আল্লাহ ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ আন্তরিকভাবে সান্ত¡না লাভ করতে পারে এবং ধৈর্য ধারণ করার পথ খুঁজে পায়। ‘নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব।’ মনে হয় যেন এ দোয়ার মাধ্যমে বলা হয়, হে মাইয়েত, তুমি যেভাবে আল্লাহ্র সান্নিধ্যে চলে গেলে, আমাদেরও একই পথে যেতে হবে। বরং তুমি আমাদের অগ্রজ। মূলত এর মাধ্যমে একদিকে নিজের সান্ত¡না অন্যদিকে মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ফুটে ওঠে।

মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে উত্তম কথা বলা

মানুষ যখন অসুস্থ হয় বা মারা যায়, তখন সে অসহায় হয়ে পড়ে। অসুস্থ মানুষের কাছে গিয়ে সান্ত¡নামূলক কথা বলে তার সাহস জোগাতে হয়। আর মারা গেলে মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে উত্তম কথা ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। দূর থেকে কারও মৃত বা অসুস্থতার সংবাদ পেলেও এমনই আচরণ করতে হবে। এটিই ইসলামের মহানুভবতা। এ প্রসঙ্গে রাসুল ((সা.) বলেছেন, হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা কোনো রোগী অথবা মৃত ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হলে উত্তম কথা বলবে। কারণ, তোমরা যা বলো, তার ওপর ফেরেশতারা আমিন বলেন। (মুসলিম : ২১৬৮)

মৃত ব্যক্তির কোনো সমালোচনা না করা

মানুষ মারা গেলে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। নতুন কিছু করার সুযোগ আর নেই। জীবনে ভালো-মন্দ যা আমল করেছে, তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে গেছে। কাজেই তাদের মন্দ বলা, গালি দেওয়া বা সমালোচনা করা একেবারেই অমূলক ও নিষেধ। এর মাধ্যমে নিজেকেই পাপী বানানো হয় এবং অন্যদিকে মরহুমের আপনজনরাও কষ্ট পায়। এজন্য নিজে ক্ষমা করা এবং আল্লাহও যেন ক্ষমা করেন সে প্রার্থনা করাই নবীজির শিক্ষা। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা মৃতদের গালি দিও না। কারণ, তারা যা পাঠিয়েছে, সে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। (বোখারি : ১৩২৯) আরও বলা হয়েছেÑ রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা মৃতদের গালি দিও না। কারণ, এতে জীবিতদের (মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের) কষ্ট দেওয়া হয়। (আত-তিরমিজি : ১৯৮২)

মৃত ব্যক্তির মাগফিরাত কামনা করা

মৃত ব্যক্তির জন্য তার কল্যাণকামী হয়ে তার কাছে কোরআন তেলাওয়াত করা বিশেষভাবে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করা প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। পরিচিত, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ ঈমানদার মানুষের মৃতুর সংবাদ পেলে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করাকে জীবিতদের পক্ষ থেকে মৃত ব্যক্তির জন্য উত্তম উপহার হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেনÑ কবরে একজন মৃত ব্যক্তি অন্ধকারে ডুবন্ত ব্যক্তির মতো। তারা পিতা-মাতা, ভাই ও বন্ধুদের দোয়ার জন্য প্রতীক্ষায় থাকেন। যখন তাদের কাছে সে দোয়া পৌঁছে তখন তা দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে এর চেয়েও অধিক প্রিয় হয়ে যায়। আর আল্লাহ তায়ালা কবরবাসীর কাছে পৃথিবীবাসীদের দোয়াকে পাহাড়সম বড় করে উপস্থাপন করে দেন। জীবিতদের পক্ষ থেকে মৃতদের জন্য সর্বোত্তম হাদিয়া হলো তাদের জন্য ইস্তিগফার কামনা করা। (আবুল ঈমান : ৯২৯৫)

মৃত ব্যক্তিকে গোসল, কাফন ও সুগন্ধি দেওয়া

মৃত ব্যক্তি মূলত আল্লাহর পথের যাত্রী। কাজেই তাকে সেভাবেই পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে পাঠাতে হবে। মৃত ব্যক্তি যেহেতু নিজে পারে না, কাজেই জীবিতদেরই সেই দায়িত্ব নিতে হবে। মৃত ব্যক্তিকে গোসল, কাফন ও সুগন্ধি মাখানো অনেক বড় সওয়াবের কাজ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ হজরত আলী (রা.) থেকে বর্র্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেনÑ যে ব্যক্তি কোনো মৃতকে গোসল দেয়, কাফন পরায়, সুগন্ধি লাগিয়ে দেয়, খাটিয়া বহন করে নিয়ে যায়, জানাজা পড়ে এবং তার কোনো দোষ জেনে গেলে তা গোপন করে সে ওইদিনে মতো পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যায়, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছে। (সুনানু ইবন মাজাহ : ১৪৬২)

লাশের অনুগমন

মৃতকে গোসল দিয়ে এবং কাফন পরিধান করিয়ে খাটিয়ায় রাখা হয়। এরপর খাটিয়া বহন করে জানাজার মাঠে এবং গোরস্তানে নেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তির খাটিয়া নেওয়ার সময়ও লাশের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়। যেমনÑ চারজন লোক খাটিয়া বহন করা, ধীরস্থিরভাবে খাটিয়া নিয়ে চলা, মুসল্লিদের খাটিয়ার পেছনে পেছনে হেঁটে যাওয়া, খাটিয়া রাখার আগে মুসল্লিরা না বসা, লাশ দেখে দাঁড়ানো ইত্যাদি। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, যখন তোমরা লাশ দেখবে দাঁড়িয়ে যাবে এবং যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে, সে যেন তা রাখার আগে না বসে। বোখারি/৩১০৩; মুসলিম/২২৬৫। আরও বর্ণিত হয়েছে, হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুল (সা.) এর সঙ্গে জানাজা আদায়ের জন্য বের হলাম। তখন তিনি কিছু লোককে যানবাহনে আরোহণ অবস্থায় দেখলেন। তখন তিনি বললেন, তোমাদের লজ্জা হয় না! আল্লাহর ফেরেশতারা হেঁটে চলছেন, আর তোমরা যানবাহনের পিঠে আরোহণ করে চলছ। (আত-তিরমিজি : ১০১২; সুনানু ইবন মাজাহ : ১৪৪০)

মৃত ব্যক্তির শরীরে আঘাত না দেওয়া

মৃত ব্যক্তির প্রতি এতটাই আদব ও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, যেন কোনোভাবেই মৃত ব্যক্তির শরীরে আঘাত না লাগে। এজন্য মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া, কাফন পরানো, নিয়ে চলা, কবরে নামানোসহ সব কাজে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। হাদিসে মৃত ব্যক্তির হাড় ভেঙে ফেলাকে জীবিত মানুষের হাড় ভেঙে ফেলার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কাটাছেঁড়া করতে নিষেধ করা হয়েছে। এজন্য রাষ্ট্রীয় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মৃতদেহ পোস্টমর্টেম করাও মৃত্যের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, মৃত ব্যক্তির হাড় ভেঙে ফেলা জীবিত মানুষের হাড় ভেঙে ফেলার মতো। (সুনানু আবি দাউদ : ৩২০৯; সুনানু ইবন মাজাহ : ১৬৮৪)

জানাজা

ঈমানদার ব্যক্তির লাশকে জানাজার মাধ্যমে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চিরবিদায় জানানো হয়। এর মাধ্যমে মৃতের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। জানাজায় মুসল্লিদের উপস্থিতি বেশি হলে মৃতের সুপারিশ ও মাগফিরাত কামনার সংখ্যাও বেড়ে যায়। বেশি মানুষের সুপারিশ আল্লাহ্ তায়ালা ফিরিয়ে দেন না। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্র্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, যে কোনো মৃত ব্যক্তির ওপর ১০০ জন লোক জানাজা পড়ে এবং প্রত্যেকই যদি ওই ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করে তবে ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা সুপারিশ কবুল করেন। (মুসলিম : ২২৪১)

মৃতের দাফন

অবশেষে মুসলমানের মৃত লাশকে কবরে সম্মানের সঙ্গে দাফন করা হয়। পরিচ্ছন্ন কবরে আল্লাহর নামে শুইয়ে দিয়ে এমনভাবে মাটি দেওয়া হয়, যেন তা মাইয়েতের শরীরে না লেগে যায়। এর চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পদ্ধতি আর কী হতে পারে? পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানুষ যখন নিহত হয়, তখন কাকের মাধ্যমে কবর দেওয়ার পদ্ধতি মহান আল্লাহই শিখিয়েছেন।

দোয়া ও কবর জিয়ারত

মৃত ব্যক্তিকে সম্মান দেওয়ার সর্বশেষ এবং স্থায়ী পদ্ধতি হলো আজীবন দোয়ার মাধ্যমে তাদের স্মরণ করা ও মাঝেমধ্যে কবর জিয়ারত করা। মরহুম পিতামাতার জন্য দোয়া তো আল্লাহ তায়ালাই শিখিয়ে দিয়েছেন। ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়া-নি সাগিরা।’ অর্থ : হে আমার পালনকর্তা! তাদের উভয়ের (পিতা-মাতা) প্রতি দয়া করুন, যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত