সন্দেহ যখন সুখের অন্তরায়

* হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার প্রতি বান্দার যে ধারণা, আমি সে ধারণার কাছে থাকি। যদি সে আমাকে স্মরণ করে আপন মনে, আমিও তাকে স্মরণ করি আপন মনে। আর যদি সে আমাকে স্মরণ করে কোনো মজলিসে, আমি তাকে স্মরণ করি তার চেয়ে উত্তম মজলিসে। সে যদি আমার দিকে এক বিঘত আসে, আমি তার দিকে এক হাত যাই। সে যদি এক হাত আসে, আমি তার দিকে চার হাত যাই। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই’

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মান ও সহমর্মিতার ওপর নির্ভর করে দাম্পত্যজীবন সুখময় হয়। একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা ও সহানুভূতি যত গভীর হয়, দুজনের বন্ধন তত দৃঢ় হতে থাকে। আর যখনই এ সম্পর্কে বিশ্বাস ও ভালোবাসার বদলে অবিশ্বাস ও সন্দেহের অনুপ্রবেশ ঘটে, তখনই দুজনের মধ্যে বাড়তে থাকে দূরত্ব। যার ফলাফল দাম্পত্য-কলহ, নির্যাতন এবং সবশেষে পারিবারিক ভাঙন। স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি সন্দেহ থেকেই অধিকাংশ দাম্পত্য-কলহের সূত্রপাত হয়। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির কল্যাণে জীবন গতিশীল হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ইন্টারনেটের জন্য বাড়ছে পরিচিত মণ্ডল, বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় সম্পর্ক, বাড়ছে নেতিবাচক আবেগ-অনুভূতি; যা অন্যান্য সর্ম্পকগুলোর পাশাপাশি টানাপোড়েন সৃষ্টি করছে বৈবাহিক সম্পর্কেও।

অহেতুক ধারণা পোষণ করা হারাম : আদি যুগ থেকে যে নেতিবাচক আবেগটি এককভাবে সংসারের সুখকে নিঃশেষ করার জন্য যথেষ্ট, তা এই সন্দেহ। সন্দেহ বিভিন্নরূপে আমাদের সম্পর্কে অনুপ্রবেশ করে। কারোর মধ্যে থাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে, আবার কারোর মধ্যে প্রকাশ পায় অস্বাভাবিক অসুস্থরূপে। অথচ ইসলাম স্বচ্ছতার ধর্ম, নিষ্কলুষ জীবনযাপনে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এ কারণেই মানুষের প্রতি অযথা খারাপ ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই। সুন্দর ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণে ইসলাম মানুষের প্রতি সুধারণা পোষণ করতে উৎসাহিত করেছে। প্রমাণ ছাড়া কোনো মুসলমানের প্রতি কুধারণা বা অহেতুক খারাপ ধারণা পোষণ করা হারাম। এর ফলে পরস্পরের প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়; সামাজিক সুসম্পর্ক ছিন্ন হয়। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক ঐক্য, সাম্য ও সম্প্রীতি নষ্ট হয়। অহেতুক ধারণা থেকেই মিথ্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে বিনা কারণে কারো প্রতি অহেতুক ধারণা করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। অহেতুক কুধারণাকারীর প্রতি মারাত্মক অভিসম্পাত করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা বিনা অপরাধে ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব : ৫৮)।

দোষ খোঁজা ও পেছনে সমালোচনা করা নিষেধ : ইসলাম মানুষকে অন্যের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করার নির্দেশ দেয়। কাউকে অহেতুক সন্দেহ করতে নিষেধ করেছে। মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করা, দোষ খুঁজে বেড়ানো, পেছনে সমালোচনা করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কোরআনের বহু আয়াত ও হাদিসে এ ধরনের সন্দেহ, গোয়েন্দাবৃত্তি ও দোষ খোঁজার অভ্যাসের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিন! তোমরা অন্যের ব্যাপারে অধিকাংশ অনুমান করা থেকে বিরত থাক। ধারণা করা অনেক ক্ষেত্রেই গোনাহের কাজ। তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় খুঁজে বেড়িও না। কারো অনুপস্থিতিতে তার নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? তোমরা তো একে ঘৃণা কর। আল্লাহকে ভয় কর; নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।

সন্দেহ করা বড় মিথ্যাচার : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা সন্দেহ করা থেকে বিরত থাক। কারণ, সন্দেহ হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার। পরস্পরের বিরুদ্ধে তথ্য তালাশ করো না এবং গোয়েন্দাগিরি করো না।’ (বোখারি : ৪৯১৭)।

সন্দেহের ফল লাঞ্ছনা : সন্দেহের ব্যাপারে হাদিসে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এ রকম অভ্যাসের কারণে দুনিয়াতেই লাঞ্ছিত হতে হবে বলে সাবধান করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা মুখে ঈমান এনেছে এবং যাদের হৃদয়ে ঈমান স্থান পায়নি, তারা শোন! তোমরা মুসলমানদের গিবত করো না এবং তাদের দোষ খুঁজে বেড়িও না। যে ব্যক্তি তাদের দোষ খুঁজবে, আল্লাহ তার দোষ ধরবেন। আর আল্লাহ যার দোষ ধরবেন, তাকে তার ঘরের ভেতরেও লাঞ্ছিত করবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৮৮২)।

ইসলামে গোয়েন্দাগিরি করা নিষেধ : সাম্প্রতিককালে অনেক দম্পতির মধ্যে সম্পর্কের শুরু থেকেই পরস্পরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহের প্রবণতা দেখা যায়। পরস্পরের ওপর গোয়েন্দাবৃত্তিকে পরস্পরের অধিকার ও স্বাভাবিক বিষয় মনে করা হয়। ফলে অনেক সময়ই ছোটখাটো কারণে অথবা কোনো কারণ ছাড়াই তাদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়। ছোটখাটো বিষয় বড় হয়ে বিয়েবিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটে। বর্তমানে অনেকেই সঙ্গী বা সঙ্গিনীর অগোচরে তাদের মোবাইল চেক করে। ফেসবুকসহ অন্যান্য ম্যাসেজ-অ্যাপগুলোর ইনবক্স চেক করে। এ ধরনের গোয়েন্দাবৃত্তি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সফর থেকে এসে রাতে ঘরে ফেরা অপছন্দ করতেন।’ (বোখারি : ৪৮১২)। অন্য বর্ণনায় এ নিষেধাজ্ঞার কারণও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সফর থেকে ফিরে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহবশত বা তার ওপর গোয়েন্দাগিরির উদ্দেশ্যে রাতের বেলা অতর্কিতে ঘরে গিয়ে উপস্থিত হতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম : ৪৮১৬)।

সন্দেহের কাজে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সুধারণা রাখা : যতক্ষণ পর্যন্ত স্বামী বা স্ত্রী সন্দেহজনক কিছু না করছে, ততক্ষণ পরস্পরের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করা চাই। প্রকাশ্য কথা ও আচরণ অনুযায়ী পরস্পরের সঙ্গে সদ্ব্যবহার ও সদাচরণ করতে হবে। গোপনীয় বিষয় আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে আল্লাহ তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে বরকত দান করবেন, পরিবারে শান্তি ও ভালোবাসা দান করবেন; প্রত্যেককেই বিশ্বস্ত থাকতে সাহায্য করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের মনে যেসব কথা আসে, আল্লাহ তা মাফ করে দিয়েছেন যে পর্যন্ত না সে অনুযায়ী কোনো কাজ করে বা মুখে উচ্চারণ করে।’ (বোখারি : ৬৬৬৪)।

সুধারণা রাখা মোমিনের কর্তব্য : হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার প্রতি বান্দার যে ধারণা, আমি সে ধারণার কাছে থাকি। যদি সে আমাকে স্মরণ করে আপন মনে, আমিও তাকে স্মরণ করি আপন মনে। আর যদি সে আমাকে স্মরণ করে কোনো মজলিসে, আমি তাকে স্মরণ করি তার চেয়ে উত্তম মজলিসে। সে যদি আমার দিকে এক বিঘত আসে, আমি তার দিকে এক হাত যাই। সে যদি এক হাত আসে, আমি তার দিকে চার হাত যাই। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।’ (বোখারি : ৭৪০৫, মুসলিম : ২৬৭৫)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকালের তিনদিন আগে বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের মৃত্যু যেন এ অবস্থায় হয় যে, সে আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করেছে।’ (মুসলিম : ২৭৮৮)।

অনুমান দ্বারা পরিচালিত হওয়া নিষেধ : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় কান-চোখ ও হৃদয়ের প্রতিটির কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৬)।

ধারণা বা অনুমান করা কাফেরের কাজ : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই, তারা কেবল ধারণা-অনুমানের অনুসরণ করে, আর সত্যের মোকাবেলায় ধারণা-অনুমান কোনো কাজে আসবে না।’ (সুরা নাজম : ২৮)।

মোমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার ভিত্তি : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। কারণ, ধারণাভিত্তিক কথাই হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। তোমরা একে অন্যের দোষ অনুসন্ধান করো না। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও দুশমনি করো না; বরং পরস্পর ভাই হয়ে যাও হে আল্লাহর বান্দারা!’ (বোখারি : ৪৮৪৯)।

ধারণা করে বিশ্বাস করা বিভ্রান্ত হওয়ার নামান্তর : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি যদি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথা অনুসরণ কর, তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে ফেলবে। তারা শুধু ধারণা-অনুমানের অনুসরণ করে। আর তারা ধারণা-অনুমান ছাড়া আর কিছুই করছে না।’ (সুরা আনআম : ১১৬)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘অনুমানকারীরা ধ্বংস হোক।’ (সুরা জারিয়াত : ১০)।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী